Hot Posts

6/recent/ticker-posts

শামীম ওসমানের রাজনৈতিক উত্থান-পতন


শামীম ওসমান, এক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, যিনি নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ও সমালোচিত। কেউ তাকে গডফাদার হিসেবে চেনে, আবার কেউ প্রভাবশালী নেতা হিসেবে। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি অনেক বার নানা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। ছাত্রজীবনে তোলারাম কলেজের ভিপি হওয়ার পর থেকে তিনি আলোচনায় আসেন এবং সময়ের সঙ্গে তার রাজনৈতিক প্রভাবও বাড়তে থাকে।

শামীম ওসমান একজন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার দাদা খান সাহেব ওসমান আলীর বাড়িতেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয় বলে জানা যায়। তবে, আওয়ামী লীগের আরেকাংশের মতে, দলটি নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় মিউচুয়াল ক্লাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক জীবনে তিনি নিজের বক্তব্য ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় আসেন জিয়াউর রহমানের গাড়িবহর আটকে দেওয়া থেকে শুরু করে খালেদা জিয়ার লংমার্চের গাড়ি আটকে দিয়ে।

তিনি আলোচিত হন ১৯৯৯ সালে নারায়ণগঞ্জের টানবাজার পতিতাপল্লী উচ্ছেদ করে। তার এসব কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি গডফাদারের খেতাব পান। তবে বিতর্কও তাকে ছাড়েনি। ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ঘটনার পর তার নাম উঠে আসে। যদিও তিনি এসব অভিযোগ বারবার অস্বীকার করেছেন।

শামীম ওসমানের রাজনৈতিক উত্থান-পতন ছিলো উল্লেখযোগ্য। ২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে গিয়ে বোরকা পরে দেশত্যাগের ঘটনা যেমন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, তেমনি ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে পরাজয় তাকে নতুন করে রাজনৈতিক চাপের মধ্যে ফেলে। এরপরেও তিনি ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পুনরায় সংসদ সদস্য হন এবং নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে তার আধিপত্য কায়েম করেন।

সম্প্রতি ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে দেশ ছেড়ে পালানোর খবর প্রকাশ পায়। এরপর তাকে প্রথম দেখা যায় ভারতের নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারে এবং পরে আরব আমিরাতের আজমান সিটি সেন্টারে। তার অনুপস্থিতি নিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীর মধ্যে নানা গুঞ্জন চলতে থাকে।

শামীম ওসমান। কারও কাছে পরিচিত গডফাদার হিসেবে। আবার কারও কাছে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে। তবে, ক্ষমতায় থাকতে তাকে অনেকেই ‘সিংহ পুরুষ’ হিসেবে অবহিত করতেন। দুর্দান্ত প্রভাবশালী এ ব্যক্তি গত ১৬ বছর কোনো না কোনোভাবে ছিলেন আলোচনায়। ছিলেন সমালোচনায়ও। কখনও কথায়, কখনও কোনো ঘটনা ঘটিয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি আলোচনায় আসেন তোলারাম কলেজের ভিপি হওয়ার পর থেকে। বিরোধী দলের লোকজন তো বটেই, নিজ দলের লোকও তার বিরুদ্ধে ছিলেন। বিপরীত দিকে আবার তার ছিলেন অসংখ্য কর্মী-সমর্থক আর শুভাকাঙ্ক্ষী।

রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম শামীম ওসমান মঞ্চে যেমন ছিলেন বাকপটু, তেমনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। রাজনৈতিকজীবনে যেমন কাঁপিয়েছিলেন রাজপথ, তেমনি সংসদেও তার বক্তব্য অনেক সময় ঝড় তুলেছিল। নানা কারণে তিনি সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন সময়ে সময়ে। ছাত্রজীবনে জিয়াউর রহমানের গাড়িবহর আটকে দিয়ে যেমন আলোচনায় আসেন। তেমনি খালেদা জিয়ার লংমার্চের গাড়িবহর আটকে দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন। টানবাজার পতিতাপল্লী উচ্ছেদ করেও আসেন আলোচনায়। একইভাবে গোলাম আজমকে নারায়ণগঞ্জে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেও রাজনীতি মহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে ‘খেলা হবে’ বলেও ‘না খেলে’ দুবার দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। একবার ২০০১ সালে, আরেকবার ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে। তবে দুবারই তাকে বোরকা পরে নারায়ণগঞ্জ ত্যাগ করতে হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব ওসমান আলীর বাসা বায়তুল আমানে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে, আওয়ামী লীগের আরেকাংশের মতে, বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়াস্থ মিউচুয়াল ক্লাবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শামীম ওসমানের দাদার পর তার বাবাও ছিলেন দাপুটে রাজনীতিবিদ। সেই সূত্র ধরেই তার রাজনীতিতে পদার্পণ আর প্রভাব বিস্তার। তবে, ব্যক্তি শামীম ওসমান পরিবারের রাজনীতির ইমেজের বাইরেও আলোচিত-সমালোচিত নানা কর্মকাণ্ডের কারণে।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে গডফাদার হয়ে ওঠেন শামীম ওসমান। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার অঙ্গুলি হেলনে চলত পুরো নারায়ণগঞ্জ। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল, প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের ঘায়েল করে কটাক্ষ বক্তব্য, প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে রাখাসহ সব কর্মকাণ্ড চলত একক ইশারায়। একপর্যায়ে আলোচিত দুর্দান্ত প্রতাবের এ নেতার কপালে জোটে গডফাদারের খেতাব। প্রকাশ্যে অস্ত্রসহ ২০-২৫টি প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে মহড়া দেওয়া ছিল তার প্রায় প্রতিদিনের রুটিন। তবে, ২০০১ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করেও প্রভাবশালী এ নেতা জিততে পারেননি। জোটপ্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের কাছে ধরা খেয়ে রাতের আঁধারে বোরকা পড়ে পালিয়ে যান শামীম ওসমান। তখন প্রথমে ভারত ও পরে কানাডায় আশ্রয় নেন তিনি। বোরকা পরে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তখন দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় তোলে।

আইনগত জটিলতার কারণে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের টিকিট থেকে বঞ্চিত হন আলোচিত এ রাজনীতিবিদ। সে সময় শামীম ওসমানের চাচি চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে মনোনয়ন পান। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন পান তার আপন বড় ভাই জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ওসমান। কবরী ও নাসিম ওসমান দুজনই সে নির্বাচনে বিজয়ী হন। প্রায় আট বছর পর ২০০৯ সালের এপ্রিলে তিনি নারায়ণগঞ্জে ফিরে আসেন, যখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দল ক্ষমতায় ফিরেছিল। সেই থেকে আবারও নারায়ণগঞ্জে শুরু হয় ওসমানীয় শাসনামল।

২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে তিনি সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে এক লাখ এক হাজার ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। তাকে হারিয়ে বাংলাদেশে প্রথম নারী সিটি মেয়র নির্বাচন হন সেলিনা হায়াৎ আইভি। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পান শামীম ওসমান। এরপর আর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি সপ্তম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালে অসহযোগ আন্দোলনের পর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করলে তিনি সংসদ সদস্যের পদ হারান।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর সশস্ত্র হামলার পর কয়েকদিন শামীম ওসমানকে কোথাও দেখা যায়নি, খোঁজও মেলেনি। এমনকি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার দিন থেকে শুরু করে এর কয়েকদিন পরও তার বা তার পরিবারের কারোরই খোঁজ পায়নি নারায়ণগঞ্জবাসী। তিনি ও তার স্বজনরা দেশে, নাকি বাইরে আছেন তা নিয়ে সে সময় ছিল নানা গুঞ্জন, আলোচনা-সমালোচনা। সেই গুঞ্জন, আলোচনা-সমালোচনার একপর্যায়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করার তার ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই শামীম ওসমানকে ২৫ সেপ্টেম্বর ফের দেখা যায় দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্মোকিং জোনে। এমন ঘটনার পর শামীম ওসমানকে ঘিরে শুরু হয় নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা। সর্বশেষ গত ১ অক্টোবর শামীম ওসমানকে আরব আমিরাতের আজমান সিটি সেন্টারে প্রকাশ্যে দেখা যায়।

নানা সময় নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় থাকতেন এ রাজনীতিবিদ

ছাত্রজীবনে নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজের ভিপি হয়ে যেমন আলোচনায় আসেন। তেমনি অনেক সময় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে কেন্দ্র ও নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে নিজের অবস্থান হারাতেন শামীম ওসমান। এর ফলে নিজ আসনে তার ব্যবসায়িক ও আধিপত্যের জায়গাগুলো তখন দুর্বল হয়ে পড়ত। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য একাধারে তিনি দেশজুড়ে থাকতেন আলোচনা-সমালোচনায়।

জিয়াউর রহমানের গাড়িবহর, খালেদা জিয়ার লংমার্চে বাধা; গোলাম আজমকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা


নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে ভিপি হওয়ার পর তার দোর্দণ্ড প্রতাপ শুরু হয়। পাশাপাশি তার রাজনৈতিক প্রভাবও যুক্ত হয়। এ দুই প্রভাবকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জে চলে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ। ১৯৭৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকার সময় জিয়াউর রহমান নারায়ণগঞ্জে প্রবেশকালে তার গাড়িবহর আটকে দিয়ে আলোচনায় আসেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন যা তিনি অনেকটা গর্ব করে বলতেন, আমি জিয়াউর রহমানকে নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করতে দিইনি। তার গাড়ির পতাকাও ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্তু লারমার সঙ্গে চুক্তি করার প্রতিবাদে ৯৮ সালের ৯ জুন বেগম খালেদা জিয়া লংমার্চ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় শামীম ওসমান পরিকল্পিতভাবে সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে তার গাড়িবহর আটক দিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেন।

একইভাবে গোলাম আজমকে নারায়ণগঞ্জে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেও রাজনীতি মহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন তিনি।

টানবাজার পতিতাপল্লী উচ্ছেদ


শামীম ওসমানের নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে উচ্ছেদ করা হয় নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত টানবাজার পতিতালয়। যা সে সময় দেশজুড়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কিন্তু উচ্ছেদের পর পতিতাদের পুনর্বাসন না করায় অনেকে সমালোচনাও হয় তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া সে সময় শামীম ওসমানের একনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে টান বাজার যৌনকর্মীদের স্বর্ণালংকার, অর্থ ও পোশাক লুটপাট করার অভিযোগ ওঠে।

৭ খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ


২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, নজরুলের সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম। তাদের অপহরণ করেন র‌্যাব-১১ এর কিছু অর্থলোভী সদস্য। অপহরণের তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে নজরুলসহ ছয়জনের হাত-পা বাঁধা লাশ ভেসে উঠে। পরদিন ভেসে ওঠে নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ। ওই ঘটনার সঙ্গে নূর হোসেনের পাশাপাশি শামীম ওসমানের জড়িত থাকার কথা গণমাধ্যমকর্মীদের জানায় প্রয়াত নজরুল ইসলামের পরিবার। তবে, তিনি বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছিলেন। এমনকি ঘটনার শুরুতে শামীম ওসমান নূর হোসেনের পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন, ‘নূর হোসেন এ কাজ করতে পারেন না’।

স্বামী নজরুল ইসলাম অপহরণের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শামীম ওসমানের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। সেলিনা ইসলাম বিউটি তখন বলেছিলেন, ‘আমি ঘটনার পরপরই শামীম ওসমানের কাছে ছুটে যাই। আমি তাকে বলি, নূর হোসেন আমার স্বামীকে অপহরণ করেছে। আপনি আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। তিনি (শামীম ওসমান) আমাকে বলেন, নূর হোসেন এই কাজ করতে পারেন না।’

নজরুলের লাশ উদ্ধারের পর সেলিনা ইসলাম বিলাপ করতে করতে বলেছিলেন, কোর্টে যাওয়ার আগে সকালেও শামীম ওসমানকে ফোন করে আমার স্বামী বলেছিল, ভাই, হাজিরা দিতে যাইতেছি, আমারে সেইফ কইরেন। এমনই সেইফ করল? পরবর্তীতে সিদ্ধিরগঞ্জে নজরুলের এক স্মরণসভায় শামীম ওসমান বলেছিলেন, নূর হোসেনসহ যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তারাই এ ঘটনার জন্য দায়ী।

শামীম ওসমানের তখনকার বিভিন্ন বক্তব্যের সূত্র ধরে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছিলেন, কাউন্সিলর নূর হোসেন শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ লোক। নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন, পুলিশ এমনকি র‌্যাবসহ প্রশাসনের সবার ওপর ছিল তাদের প্রভাব। তাই প্রথমে নূর হোসেন, র‌্যাব ও সেই সূত্রে শামীম ওসমানের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছিল।

একপর্যায়ে এক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে শামীম ওসমান বলেছিলেন, ‘নূর হোসেন আমার কর্মী ছিল। কিন্তু সে যে এত বড় অপরাধী, সে যে নজরুলকে খুন করে ফেলতে পারে, এটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এখন আমি সব বুঝতে পারছি। তাই নূর হোসেনের ব্যাপারে আমার অবস্থান বদলেছে।’

শামীম ওসমান বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, নূর হোসেন সর্বোচ্চ হাতাহাতি করতে পারে। কিন্তু সে যে এভাবে নজরুলকে মেরে ফেলবে, সেটা আমি বুঝতে পারিনি।’

বেসরকারি টিভি চ্যানেলে আইভির সঙ্গে তর্কে জড়ানো


‘নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনে কে জড়িত কে জড়িত নয়?’— শীর্ষক এক টক-শোতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে তর্কে জড়ান শামীম ওসমান। সেই টক-শোতে আইভী সরাসরি শামীম ওসমানকে সাত খুনের সঙ্গে জড়িত বলে মন্তব্য করেছিলেন। একপর্যায়ে উভয়ের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। তাতে শামীম ওসমান আইভিকে ‘বেয়াদব’ বলে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালিও করতে দেখা যায়। এতে ব্যাপক সমালোচিত হন শামীম ওসমান।

হকার ইস্যুতে আইভির ওপর হামলা ও আইভি-শামীম দ্বন্দ্বের কারণ


২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে শামীম ওসমান এক লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। এর আগে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা, সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভা ও বন্দরের কিছু অংশকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তর করার জন্য তার অবদান ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তিনি মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তদবির করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তর করতে ভূমিকা রাখেন। তার প্রত্যাশা ছিল তিনি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হবেন। কিন্তু তার সেই আশায় গুড়ে বালি। সেলিনা হায়াৎ আইভির কাছে চরমভাবে পরাজয় বরণ করার পর থেকে শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভির সাথে দ্বন্দ্ব প্রকট হতে থাকে। ২০১৬ সালে শামীম ওসমান আর দলীয় মনোনয়ন পাননি। আইভী দ্বিতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হলে দলে তার গুরুত্ব বাড়ে। জনমতে হেরে যাওয়া এবং বারবার বিতর্কে জড়ানোয় কেন্দ্রে গুরুত্ব কমে শামীম ওসমানের।

২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী কাউন্সিলরদের নিয়ে নগর ভবন থেকে পদযাত্রা করেন। বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাত হকারমুক্ত রাখতে এবং পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচলের স্বার্থে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্যে হেঁটে প্রচারণা করেন মেয়র। পদযাত্রাটি বিকেল সাড়ে ৪টায় চাষাড়া পর্যন্ত এলে শামীম ওসমানের লোকজন মেয়র আইভীর ওপর চারদিক থেকে হামলা করে। বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছোড়া হয় সেদিন। এর মধ্যেই শামীম ওসমানের অনুসারী নিয়াজুল ও শাহ নিজাম পিস্তল উঁচিয়ে আইভিকে লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলিও করেছিল। এতে আইভীসহ ৪৩ জন গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় এজাহার দাখিল করা হলেও থানা কর্তৃপক্ষ সেটি মামলা হিসেবে গ্রহণ না করে জিডি হিসেবে নথিভুক্ত করেছিল।

Post a Comment

0 Comments