গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য



গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য
সংবিধান রচনার পটভূমি
 সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক বিধিবিধানের সমষ্টি। চীনের সংবিধানও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। ১৯৪৯ সালের ১লা অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ৫ বছর পর ১৯৫৪ সালে চীনে সর্বপ্রথম একটি সংবিধান প্রবর্তন করা হয়। এটিই হল চীনের প্রথম সংবিধান। এটি সমাজতান্ত্রিক সংবিধান নামে অভিহিত। এ সবিধানের পূর্বে চীনে কোন সংবিধান রচিত হয় নি। ১৯১১ সালে এ প্রজাতন্ত্রের জন্য | একটি সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। নানা কারণে এ সংবিধান কার্যকর হয় নি। ১৯২৩ সালে এবং ১৯৪৬ সালে সংবিধান তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয় নি। বস্তুতঃ ১৯৫৪ সালের আগে দেশ পরিচালনার জন্য ব্যাপক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে একটি সংস্থা গঠন করা হয়। এ গঠন প্রক্রিয়া ছিল গণতান্ত্রিক। দলমত নির্বিশেষে এক পরামর্শ সভা গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ পরামর্শ সভা দেশ পরিচালনার মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এ পরামর্শ সভার নেতৃত্বাধীনে পরবর্তীকালে চীনের সংবিধান প্রণীত হয়। 

গণসরকারের কাউন্সিল সংবিধান রচনার লক্ষ্যে ১৯৫৩ সনের জানুয়ারী মাসে একটি সংবিধান রচনা কমিটি গঠন করে। মাও সেতুং এর নেতৃত্বে এ কমিটি গঠন করা হয়। পরপর বেশ কয়েকটি অধিবেশন বসে। ১৯৫৪ সনের ৯ই সেপ্টেম্বর ৩৪তম অধিবেশনে সংবিধানের চুড়ান্ত খসড়া গৃহীত হয়। অবশেষে ১৯৫৪ সনের ২০শে সেপ্টেম্বর জাতীয় গণকংগ্রেস সর্বসম্মতি ক্রমে খসড়া সংবিধানটি অনুমােদন করে। যারই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪ সনের সংবিধানের সৃষ্টি। ১৯৯২ সালে এ সংবিধানটি পরবর্তীকালে প্রণীত সংবিধানের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। চীনে বর্তমানে ১৯৮২ সালের সংবিধান বিদ্যমান। আসুন আমরা ১৯৮২ সালের সংবিধান সম্পর্কে জ্ঞাত হই। 
১৯৮২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য

 ১৯৮২ সালের সংবিধান চীনের একটি বিশেষ দলিল। এ সংবিধানটি বিশ্লেষণ করলে কতিপয় বৈশিষ্ট্য।

স্পষ্ট হয়ে উঠে। এগুলাে পর্যায়ক্রমে নিয়ে আলােচনা করা হল। 
  • প্রস্তাবনা প্রস্তাবনা ১৯৮২ সালের সংবিধানের প্রথম বৈশিষ্ট্য। এটি চীনের প্রতিটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি সংবিধানের মুখবদ্ধ স্বরূপ। এ প্রস্তাবনায় সংবিধান প্রণেতাগণের ইচ্ছা, সংবিধানের উৎস, আইনগত ও সংবিধানের প্রস্তাবনা পর্যালােচনা করলে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রীয় বব্যস্থা, সরকারী কাঠামাে, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মূলনীতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়।
  •  লিখিত ঃ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ১৯৮২ সনের সংবিধানটি ছিল লিখিত সংবিধান। এ সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা ও ১৩৮টি ধারা ছিল। এগুলাে স্পষ্টভাবে লিখিত ছিল। এছাড়া রাষ্ট্রীয় সাধারণ নীতি, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাঠামাে, গঠন ক্ষমতা, কার্যাবলী এবং অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে লিখিতভাবে উল্লেখ রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকাংশ বিধি-বিধান লিখিত। 
  • পরিবর্তনীয়  দুস্পরিবর্তনীয়তা ১৯৮২ সনের সংবিধানের একটি উল্লেখযােগ্য দিক। চীনের এ সংবিধানটি পুরাতন সােভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানের ন্যায় দুষ্পরিবর্তনীয়। সাধারণ আইন পাশের ন্যায় এ সংবিধানটি সংশােধন ও পরিবর্তন করা যায় না। এটি বাংলাদেশ ও আমেরিকার সংবিধানের সাথে তুলনীয়। এ সংবিধানের ৬৪ নং ধারায় সংশােধনী সম্পর্কে স্পষ্ট বিধান রাখা আছে। 
  • সাংবিধানিক প্রধান্যঃ ১৯৮২ সালের চীনের সংবিধানে সাংবিধানিক প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এ সংবিধানটিকে রাষ্ট্রের মৌলিক আইন হিসেবে ঘােষণা করা হয়েছে।
  • সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রঃ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বর্তমান সংবিধানের একটি মৌলিক দিক। এ সংবিধানের উদ্দেশ্য ছিল কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত জনগণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। চীনের দ্বাদশ জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যাতি করা হয়। প্রকৃত পক্ষে তত্বগতভাবে সমাজতান্ত্রিক একনায়কত্ব হল সর্বহারাদের একনায়কত্ব'। 
  • জনগণের সার্বভৌমত্বঃ ১৯৮২ সালের চীনের বর্তমান সংবিধানকে বিশ্লেষণ করলে জনগণের সার্বভৌমত্ব লক্ষ্য করা যায়। মূলতঃ রাষ্ট্রীয় প্রশাসন জনগণের উপর ন্যাস্ত। জনগণের মতানুসারে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলাে পরিচালনা করে থাকে। 
  • গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাঃ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা বর্তমান সংবিধানের একটি অন্যতম দিক। ৮২ সালের সংবিধানে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা লক্ষ্য করা যায়। চীনের সমাজতন্ত্রিক ব্যবস্থা বিশেষধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা আমলাতন্ত্রের বিরােধী। গণতন্ত্র ও কেন্দ্রিকতা এ দু'য়ের সমন্বয়ে হল গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। মাংসেতুং-এর ভাষায় ‘জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মত শৃঙ্খলা ও কেন্দ্রিকতার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
  •  সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাঃ সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ১৯৮২ সালের সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ কারণে চীনে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। এ ব্যাপারে সংবিধানের ৬নং ধারায় বিধান রাখা হয়েছে। উৎপাদন ব্যবস্থায় মালিকানাকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এ দুটি হল-ক, সমস্ত জনগণের মালিকানা, খ, শ্রমজীবী মানুষের যৌথ মালিকানা চীনে সমাজতান্ত্রিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত। 
  • সম্পত্তি বন্টনের নীতি: চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি রয়েছে। এর পাশাপাশি সম্পত্তি বন্টনের নীতি সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এ ব্যাপারে সংবিধানের ৬নং ধারার বলা হয়। তবে ৭৮ সনের সংবিধানেও সমাজতান্ত্রিক বন্টননীতি উল্লেখ ছিল। 
  • পররাষ্ট্র নীতিঃ পররাষ্ট্র নীতি চীনের বর্তমান সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ আছে যে, বিপ্লবােত্তর চীন বিনির্মানের জন্য বৈদেশিক সাহায্য ও সহােযােগিতা দরকার। অর্থাৎ বৈদেশিক বিনিয়ােগকে স্বাগত জানায়। এ বিনিয়ােগ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে সাহায্য করবে বলে তাদের বিশ্বাস। এ কারণে বৈদেশিক শিল্প প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক সংস্থা ও পুঁজি বিনেয়ােগের অনুমতি দেয়া হয়। তারা অবশ্য চীনের অর্থনৈতিক বিধি-বিধান মেনে চলবে।
  •  রাজনৈতিক আশ্রয়  বর্তমান সংবিধানকে বিশ্বেষণ করলে রাজনৈতিক আশ্রয়-এর ধারার উপস্থিতিতে লক্ষ্য করা যায়। এটি হল সংবিধানের একটি অভিনব বৈশিষ্ট্য। বর্তমান সংবিধানে বিদেশী নাগরিকদের রাজনৈতিক আশ্রয়দানের সুযােগ রয়েছে। সংবিধানের ৩২ নং ধারায় বলা 26316367, The people's Republic of China may grant asylum to foreigners who request it for political reasons. 
  • কেন্দ্রিয় আইনসভা ঃ ১৯৮২ সনের সংবিধানে কেন্দ্রীয় আইন সভার বিধান রাখা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রীয় আইনসভা হল জাতীয় কংগ্রেস। এটি ছিল এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা। উক্ত সংবিধানে বলা হয় যে জাতীয় কংগ্রেস হল চীনের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি সভা এবং এটি হবে এক কক্ষ বিশিষ্ট। বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রতিনিধি নিয়ে চীনের এ আইন সভা গঠিত। 
  • রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি ঃ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৮২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি বিধান রাখা হয়। এ ব্যাপারে সংবিধানের ৭৯ নং ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এ ধারায় উল্লেখ করা হয় যে, গণকংগ্রেস চীনের রাষ্ট্রপতি ও উপ- রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন করবেন। ৪৫ বছর বয়স্ক ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি ও উপ- রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হতে পারেন। এদের কার্যকাল ৫ বছর। তারা একাধিকক্রমে দুবারের বেশী নির্বাচিত হতে পারেন না। 
  • নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য: অন্যান্য সংবিধানের ন্যায় চীনের বর্তমান সংবিধানে নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের বিধান রাখা হয়েছে। সংবিধানের ৩৩নং ধারা থেকে ৫৬নং ধারায় নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। মৌলিক অধিকারগুলাের মধ্যে, আইনের সাম্যতা, বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কর্মের অধিকার বিশেষভাবে উল্লেখ যােগ্য। পাশাপাশি কর্তব্যের মধ্যে আইনমান্য, সেনাবাহিনীতে যােগদান, আক্রমণ প্রতিহত, শৃংখলা রক্ষা ও কর প্রদান করা বিশেষভাবে প্রণিধান যােগ্য। 
  • কেন্দ্রিয় সামরিক কমিশন ঃ বর্তমান সংবিধানে কেন্দ্রীয় কমিশন গঠনের কথা উল্লেখ রয়েছে। চীনের সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিচালিকা শক্তি হল এ কমিশন। এ কমিশন সমস্ত বাহিনীকে নির্দেশ করে। একজন সভাপতি কয়েকজন সহসভাপতি ও কতিপয় সদস্য নিয়ে এ কমিশন গঠিত হবে। এ কমিশনের সমস্ত দায়িত্ব সভাপতির উপর ন্যাস্ত। এ কমিশনের কার্যকাল জাতীয় কংগ্রেসের কার্যকালের ন্যায় ৫ বছর। এ কমিশন গণকংগ্রেসের কাছে দায়িত্বশীল।

সারকথা | 
চীন বর্তমান বিশ্বের একটি শক্তিধর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। চীন সম্মিলিত জাতিসংঘেরও বৃহৎ শক্তির অন্যতম। ১৯৪৯ সনের ১লা অক্টোবর চীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে আবির্ভূত হয়। প্রতিষ্ঠা লাভের ৫ বছরের মধ্যে চীন একটি সংবিধান প্রণয়ন করে। ১৯৫৪ সনের ২০শে সেপ্টেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের সর্বসম্মতিক্রমে এটি গৃহীত হয়। এটিই চীনের ইতিহাসের প্রথম সংবিধান। ১৯৫৪, ১৯৭৫, ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সনে পর পর চারটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। এগুলাের মধ্যে ৮২'এর সংবিধান বিশেষভাবে প্রনিধানযােগ্য। এ সংবিধানটি বর্তমান চীনের মূল চালিকা শক্তি।

Post a Comment

Previous Post Next Post