স্থানীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে আলােচনা করতে গেলে কেন্দ্রিয় সরকারের সাথে স্থানীয় সরকারের সম্পর্ক ও সেই সাথে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের পাথক্য উল্লেখ করা প্রয়ােজন।
স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থায় জনগণের অংশিদারিত্ব নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত হয়েছে। এই স্বায়ত্তশাসনে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে।
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার মূলত সেই ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা যা স্ব-স্ব এলাকার সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অধিকাংশ স্বশাসন ভােগ করে থাকে। জনগণ কর্মকাণ্ডের সাথে এবং প্রতিটি নির্বাচনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে।
স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদ। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার, অন্যদিকে জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকার। সাধারণত স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট রুপে পরিচালিত হয়। এদের নিজস্ব কোন নীতি নেই এবং এরা পরিচালিত হয় কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে। অন্যদিকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের নিজস্ব নীতি রয়েছে। নিজস্ব গন্ডিতে এরা তাদের কতৃত্ব বজায় রাখতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের দেয়া দায়িত্ব তারা পালন করে। নির্বাচন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি নিরিখে এ দুই সংস্থার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থায় জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের কাঠামােয় নির্বাচিত হয়ে থাকেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধিত্ব সরাসরি নয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা (এমনকি মহিলা সদস্যরাও) এখন জনগণের সরাসরি ভােটে নির্বাচিত হয়। অন্যদিকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের জেলার সকল জনগণের ভােটে নির্বাচিত হওয়ার কোন বিধান নেই। উপরন্তু সেখানে রয়েছে মনােনয়ন ব্যবস্থা। নিবাচিত সদস্যদের পাশাপাশি জেলা পরিষদে সরকারী সদস্যরাও রয়েছেন। কর্মকর্তা নিয়ােগের | ক্ষেত্রেও স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের স্থানীয় পরিষদ কর্মকর্তাদের নিয়ােগ দিয়ে থাকেন। কিন্তু স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তারা নিয়ােগ লাভ করেন কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে স্থানীয় সরকারের যেমনি সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারেরও সম্পর্ক রয়েছে। তবে এখানে সুস্পষ্ট একটি পাথক্য রয়েছে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের কাঠামােয় কেন্দ্রীয় সরকার কোন কর্মকর্তা নিয়ােগ দেন না। সরকারের কোন প্রতিনিধি নেই এখানে। তবে সরকার প্রয়ােজন বােধে আর্থিক অনুদান দেন। সরকারের অনুদান নিয়ে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকার কাঠামােয় কর্মকর্তা নিয়ােগ দেন। আর এই আমলারা স্থানীয় সরকারের স্বার্থের চাইতে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থকেই বড় করে দেখেন। তবে ইদানিং স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্য কমে আসছে। স্থানীয় সরকার আরাে প্রতিনিধিত্বশীল হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্য কমে আসছে।বলা যেতে পারে রাষ্ট্রের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি স্থানীয় সরকারের হাতে। জনহিতকর কার্যাবলী থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করে থাকে। স্থানীয় সরকারের কার্যালী অনেকটা নিম্নরূপঃ
- স্থানীয় এলাকায় জনশিক্ষা, বিশেষ করে, নারী শিক্ষা, উন্নয়ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সঞ্চার কিংবা নির্মাণ, মসজিদ মাদ্রাসার সম্প্রসারণ ইত্যাদি দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের উপর ন্যস্ত।
- স্থানীয় পর্যায়ে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পুল-কালভার্ট নির্মাণ, সুপেয় পানি সরাহের ব্যবস্থা করা, প্রাথমিক চিকিৎসালয় । স্থাপন ও রক্ষনাবেক্ষণ ইত্যাদি স্থানীয় সরকারের আওতামুক্ত।
- স্থানীয় আইন শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, কৃষি উৎপাদন, সালিশী করা ও সীমিত পর্যায়ে বিচার নিষ্পত্তি করা ইত্যাদিও। স্থানীয় সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
- কাজের বিনিময় খাদ্য বা তদ্রুপ অন্যান্য কর্মসূচিও তদারকি করে স্থানীয় সরকার।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্থানীয় সরকার এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভােগ করে থাকে। যেমন, ইউনিয়ন পরিষদের কথা যদি আমরা আলােচনা করি, তাহলে দেখতে পাব ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় পর্যায়ে কর আরােপের ক্ষমতা রাখে। জনগণের সরাসরি ভােটে এরা নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় সরকারের কোন কতৃত্ব এদের উপর থাকে না। পরিষদের কর্মকর্তা নিয়ােগের ক্ষেত্রেও স্থানীয় পরিষদ স্বাধীন। এর ফলে স্থানীয় সরকার স্ব- শাসিতভাবে পরিচালিত হচেছ। এই স্ব-শাসন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য খুবই প্রয়ােজন। কেননা, গণতান্ত্রর মূল কথা হচেছ জনগণের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর জনগণের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যদি জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। স্থানীয় পর্যায়ে এ কতৃত্ব নিশ্চিত হয়েছে। জনগণ তাদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারছেন। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। কেননা, জনগণের ভােটে তারা নির্বাচিত। ফলে তারা জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি হাতে নেন এবং জনগণের স্বার্থেই তারা কাজ করতে বাধ্য হন। একজন মনােনীত কিংবা অ-নির্বাচিত ব্যক্তি জনকল্যাণমুখী নীতি ততটা কার্যকরভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। তাদের কোন দায়বদ্ধতা থাকে না। স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ায় গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে যদি জনগণের কতৃত্ব নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে একটি সমাজে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গণতন্ত্রের সুষ্ঠ বিকাশ ও গণতান্ত্রিক কাঠামাে গড়ে তােলার জন্য তাই স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের কতৃত্ব ও অংশগ্রহণ জরুরি। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশােধনীর মাধ্যমে সংসদীয় রাজনীতি চালু হয়েছে। এ সংসদীয় রাজনীতির সাফল্যের একটি অন্যতম শর্ত হচেছ স্থানীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ভাবধারাকে সম্প্রসারিত করা। স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র বিকশিত না হলে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। সুতরাং স্থানীয় পর্যায়ে আজ বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক ভাবধারা বিকাশ লাভ করছে, তা আরাে সম্প্রসারিত করতে হবে। উপজেলা ছাড়িয়ে জেলা পর্যায়ে স্থানীয় সরকার কাঠামােয় যদি জনগণের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব
নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সঠিকভাবে তা দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলােকে আরাে শক্তিশালী করবে এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী | ভিত্তি দিতে সাহায্য করবে।
0 Comments