Hot Posts

6/recent/ticker-posts

এলিট তত্ত্ব কী? বাংলাদেশের রাজনীতি বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্বের কার্যকারিতা এবং উন্নয়নশীল দেশে এলিটদের অবদান পর্যালােচনা কর।

এলিট তত্ব : আভিধানিক অর্থে এলিটবাদ উৎকৃষ্ট শ্রেণির মুষ্টিমেয় শাসককে বুঝায়। প্রকৃতপক্ষে এলিটবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলাে সব সমাজেই দুটি প্রধান শ্রেণির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এক শ্রেণি মুষ্টিমেয় ব্যক্তি (দক্ষ ও নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন) যারা শাসক আর অপর শ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ (সাধারণ জনগণ) যারা শাসিত হয়, তাদের সমন্বয়ে গঠিত। এটি হচ্ছে এলিট তত্ত্বের মূলকথা। সুতরাং এলিট তত্ত্ব অনুযায়ী যেভাবেই বা যে কোন কারণেই হােক না কেন প্রতিটি সমাজেই জনসংখ্যার সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র অংশ শাসন করে এবং সংখ্যাধিক্য জনগােষ্ঠী শাসিত হয়।


নিম্নে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রদত্ত কতিপয় সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলাে :

প্যারেটো তার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ 'The Mind and Society' এ এলিটের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “এলিট হচ্ছে এমন এক জনসমষ্টি যাদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে সর্বাধিক দক্ষতা রয়েছে।"

মসকা তার 'The Rulling Class গ্রন্থে এলিট তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, "সকল সমাজেই দু'শ্রেণির জনগণ দেখা যায়, এক শ্রেণি যারা শাসন করে এবং অপর শ্রেণি যারা শাসিত হয়। শাসকশ্রেণি সবসময় সংখ্যায় স্বল্প কিয় তারাই সব রাজনৈতিক কার্যসম্পন্ন করে থাকে। এ শ্রেণিই সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে এবং তা থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় সুযােগ সুবিধা ভােগ করে।”

Zeitein এর ভাষায় ,Thus the elite of a society consists of those with the highest indices in their branches of activity."

অতএব, একথা পরিষ্কার যে একটি সমাজের উৎকৃষ্টতর, নেতৃস্থানীয় প্রভাবশালী, সংখ্যালঘু শ্রেণিই এলিট দ্বারা শাসন ক্ষমতা দখল করে কিংবা তার জন্য কথা বলে এবং সর্বোচ্চ সুযােগ সুবিধা ভােগ করে।


বাংলাদেশের রাজনীতি বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্ব : বাংলাদেশের রাজনীতি বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের শাসন মূলত এলিটদের শাসন। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলিট গােষ্ঠী শাসন ক্ষমতায় এসেছে। এলিটদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : 
ক, শাসক এলিট, 
খ, প্রভাবশালী এলিট এবং 
গ, সামরিক এলিট। 
তবে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক আমলা ও সামরিক এলিটদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক এলিটগােষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হতাে। এ সময় আইনসভার সদস্যদের নিয়ে এলিট শ্রেণি গঠিত হয়। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে এবং দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক এলিট রাজনৈতিক এলিটদের স্থলাভিষিক্ত হয়। ফলে ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে রাজনৈতিক এলিটদের ক্ষমতা চলে আসে সামরিক এলিটদের হাতে।

১৯৭৫ সালের পর আমলাতান্ত্রিক এলিটগণ শাসনতান্ত্রিক এলিট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক এলিটরা সিভিল সার্ভিস ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত। তারা সমাজের উচ্চ শ্রেণির সাথে একটি পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। ফলে তারা যে নীতি প্রণয়ন করে তা উচ্চ শ্রেণির স্বার্থেই করে। ১৯৮১ সালের মে মাসে জেনারেল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ক্ষমতায় আসেন। এ সময় আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক এলিটদের প্রাধান্য থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক এলিটরাই সকল প্রকার সিদ্ধান্ত নিতেন। 
১৯৮২ সালের পর থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সামরিক এলিটরাই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। ১৯৯০ সালের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত চারটি সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যেক সরকারের আমলেই কতিপয় সামরিক ও আমলাদের নিয়ে গঠিত একটি এলিট শ্রেণি প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। সুতরাং বলা যায় যে, একটি ক্ষুদ্র গােষ্ঠী বাংলাদেশের শাসনকারী এলিট।



উন্নয়নশীল দেশে এলিটদের অবদান পর্যালােচনা কর।



উন্নয়নশীল দেশে এলিটদের ভূমিকা : নিম্নে উন্নয়নশীল দেশে এলিটদের ভূমিকা বা অবদান আলােচনা করা হলাে : 

 ১, রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে : উন্নয়নশীল দেশগুলােকে ঔপনিবেশিক শাসন এ শােষণ তাদের অধীনস্ত করে রেখেছিল। এবং জনগণের ক্ষমতা, দক্ষতা ও উদ্দীপনাকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। ফলে তখন সুদৃঢ় ও সুসংহত নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে পারে নি। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর থেকেই এসব দেশে নতুন এলিট শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। তারা সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে তৎপর হয়ে উঠে। 

 ২, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ; উন্নয়নশীল দেশগুলােতে উচ্চতর সরকারি কর্মকর্তা বা এলিটগণই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে গিয়ে এলিটদের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা অধিকতর অর্থনৈতিক কল্যাণ লাভের জন্য জনগণের নতুন নতুন দাবিদাওয়া, সনাতন জীবনধারা অনুযায়ী শক্তিসমূহের বিরােধিতাজনিত সমস্যাদির মােকাবিলা করতে হয়।


৩, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে তোলা ;
 বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ ও সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ • যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হতে প্রবেশ করেছে এবং আমলাগণ. যারা নতুন রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে এসব শ্রেণি অনেক উন্নয়নশীল দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এ ধরনের এলিটগণের কাজ হলাে নতুন নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা এবং রাষ্ট্রকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়া।

৪, দায়িত্বশীল সরকার গঠন : উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ জনগণ রাজনৈতিক দিক দিয়ে সচেতন নয়। এজন্য তারা দায়িত্বশীল সরকার গঠন করতে পারে না। এক্ষেত্রে এলিট শ্রেণি তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং দায়িত্বশীল সরকার গঠনে সাহায্য করে।

৫. আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, উচ্চমানের ভােগ্যসামগ্রী ও কল্যাণ লাভের আকাক্ষা ও সে সঙ্গে সনাতনধর্মী জীবনযাত্রার সমর্থক শক্তির উপস্থিতি আধুনিকীকরণের পথে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করে চলেছে। ফলে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও অর্থনৈতিক নীতিমালা অস্থিরীকৃত ও অনিশ্চিত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। এমতাবস্থায় এলিট শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন এবং উন্নয়নের গতিধারা নির্ধারণে তারাই মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ

৬. শিক্ষার প্রসার : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অধিকাংশ লোকই অশিক্ষিত। তারা শিক্ষার আলাে থেকে বঞ্চিত। তাই উন্নয়নশীল দেশের এলিট শ্রেণি এসব অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং দেশীয় শিক্ষার সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে একটি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে তুলতে সহায়তা করে।  
৭. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন; উন্নয়নশীল দেশগুলাের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম। এসব দেশে নৈতিক তত্ত্ব ন অনৈতিক নীতিমালার অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত অবস্থা বিদ্যমান। এ অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশের এলিট শেণি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন এনে মানুষ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করে।

৮. গণতন্ত্রের বিকাশ ; গণতন্ত্রের বিকাশে এলিট শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা উন্নয়নশীল দেশের জনগন মধ্যে রানৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যােগ্য ব্যক্তিকে ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত হন এবং তাদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে গণতন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে।

Post a Comment

0 Comments