বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে স্বাধীনতার বেশ কিছু দিন পর। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্টের আদেশ বলে ইউনিয়ন কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত রাখা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে এ নাম পরিবর্তন করে ইউনিয়ন পরিষদ রাখা হয়। ১৯৭৬ সালে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ জারী করে তিনস্তর বিশিষ্ট হানীয় সরকার প্রস্তাব করা হয়। এগুলাে হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ ও জেলা পরিষদ।
১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়নকে তিনটি ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়। প্রতি ইউনিয়নে একজন চেয়ারম্যান ও ৯ জন সদস্য ছিলেন। প্রতি ওয়ার্ডে তিনজন করে সদস্য নির্বাচিত হতেন। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ভােটাররা তাদের নিজস্ব সদস্য নির্বাচন করতেন। আর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন ইউনিয়নের ভােটারদের প্রত্যক্ষ ভােটে। মহাকুমা প্রশাসক দু'জন মহিলা সদস্য মনােনীত করতেন। ১৯৭৯ সালের এক সংশােধনীর মাধ্যমে সে সাথে দু'জন কৃষক সদস্যের মনােনয়নের ব্যবস্থা করা হয়। এদের মনােনয়নের ক্ষমতা ছিল মহাকুমা প্রশাসকের হাতে। ১৯৮৩ সালে আরেক অধ্যাদেশ বলে এ ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
থানা পরিষদে সরকারি সদস্যদের পাশাপাশি বেসরকারি সদস্যরাও ছিলেন। থানার অন্তর্গত সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে থানা পরিষদের সদস্য ছিলেন। অন্যদিকে থানার অন্তর্গত সরকারি কর্মচারীরা পদাধিকার বলে থানা পরিষদের সদস্য ছিলেন। মহাকুমা প্রশাসক ও সার্কেল অফিসার যথাক্রমে পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। সবার ভােটাধিকার ছিল।
১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী জেলা পরিষদের বিধান থাকলেও জেলা পরিষদের কোন নির্বাচন হয় নি। এই পরিষদেও নির্বাচিত সদস্যদের পাশাপাশি মনােনীত ও মহিলা সদস্যদের বিধান রাখা হয়েছিল। নির্বাচিত সদস্যরা জনগণের সরাসরি ভােটে নির্বাচিত হতেন। আর মহিলা সদস্যরা সংশ্লিষ্ট জেলার নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ (অর্থাৎ কমিশনার) কর্তৃক মনােনীত হতেন। তবে মহিলাদের সংখ্যা মােট সদস্যদের এক দশমাংশের বেশী হতে পারতাে না। নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে থেকে একজনকে চেয়ারম্যান ও অন্য জনকে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করার বিধান ছিল। কিন্তু নির্বাচন না হওয়ায় পুরাতন ২২টি জেলায় জেলা পরিষদ বিদ্যমান ছিল এবং জেলা প্রশাসক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার ব্যাবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ ১৯৭৬ (ইউনিয়ন পরিষদ) এর ৮৫ ও ৮৬ নং ধারায় সরকারকে গ্রাম পরিষদ ব্যাবস্থা প্রবর্তন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮০ সালে গ্রাম সরকার অধ্যাদেশ জারী করা হয়। উক্ত গ্রাম সরকারে একজন গ্রামপ্রধান, দু'জন মহিলা সদস্য, ৯জন অন্যান্য সদস্য যারা গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণী বা গােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করবেন তাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল সর্বসম্মতিক্রমে গ্রাম প্রধান অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা মনােনীত হবেন। স্বনির্ভর গ্রাম সরকার যে বিষয়গুলাে দেখাশােনা করবে, সেগুলাে হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা কার্যকর করা, স্থানীয় আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ইত্যাদি। কিন্তু ১৯৮২ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর সাথে সাথে এই ব্যাবস্থারও বিলুপ্তি ঘটে।
স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ, ১৯৮২ ও স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ র আওতায় স্থানীয় সরকার ব্যাবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রকরণ ও দ্রুত উন্নয়নের নামে এরশাদ সরকার থানা গুলােকে প্রথমে উন্নীত থানায় রূপান্তর করে ও পরে তা উপজেলা নামকরণ করা হয়। উপজেলায় প্রশাসন পরিচালনার জন্য উপজেলা পরিষদ গঠন করা হয়। নিম্নলিখিত সদস্যদের নিয়ে উপজেলা পরিষদ গঠিত হয়; (১)চেয়ারম্যান, (২) প্রতিনিধিত্বশীল সদস্য, (৩) তিনজন মহিলা সদস্য, (৪) সরকারি কর্মচারী, (৫) একজন মনােনীত সদস্য, (৬) উপজেলার সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান। উপজেলা পরিষদে সাধারণতঃ দুধরনের সদস্য ছিল। একধরনের সদস্য ছিল, যারা ভােট দিতে পারতেন, আর অপর ধরনের সদস্য ছিল, যাদের ভােটের কোন ক্ষমতা ছিল না। সরকারী সদস্যরা ভােট দিতে পারতেন না। উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপজেলা চেয়ারম্যানের অধীনে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। উপজেলা চেয়ারম্যান জনগণের ভােটে সরাসরি নির্বাচিত হতেন। উপজেলা ছিল সমস্ত উন্নয়ন কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
উপজেলার পাশাপাশি জেলা পরিষদের কর্মকান্ড তদারকি করার জন্য জেলা পরিষদ পুনঃগঠনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়। এ উপলক্ষে স্থানীয় সরকার আইন (জেলা পরিষদ, ১৯৮৮) প্রণয়ন করা হয়। এ আইনে প্রত্যেক জেলা পরিষদ প্রতিনিধি সদস্য, মনােনীত সদস্য, মহিলা সদস্য ও সরকারী কর্মকর্তা সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। জেলার সকল সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভাগুলাে চেয়ারম্যানগণ পদাধিকার বলে জেলা পরিষদের প্রতিনিধি সদস্য হবেন। সরকারি কর্মকর্তাদের কোন ভােটাধিকার ছিল না এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হতেন।
গ্রাম পরিষদ গঠিত হবে পাঁচ বছরের জন্য। এতে থাকবেন একজন চেয়ারম্যান, ৩ জন মহিলা সহ ১২ জন সদস্য ও একজন কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য গ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান হবেন। ওয়ার্ডের এলাকাভুক্ত গ্রামগুলাে থেকে ৯ জন পুরুষ ও ৩ জন মহিলা সদস্যকে মনােনয়ন দান করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার কাঠামাে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়। ১৯৮৯ সালের স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনের বিভিন্ন ধারা পরিবর্তন, সংশােধন, সংযােজন ও রহিতকরণ করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। নতুন আইন বলে (পুরাতন তিনটি জেলা পরিষদ বহাল রেখে) একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়। পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ এর নাম পরিবর্তন করে পার্বত্য জেলা পরিষদ নামে অভিহিত করা হয়। আইনে আঞ্চলিক পরিষদকে একটি উপদেষ্টামূলক সংস্থা হিসেবে ঘােষণা করলেও, আঞ্চলিক পরিষদই মূলত পাহাড়ী রাজনীতিতে মূল। শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদের কাঠামাে নিম্নরূপ সদস্য সংখ্যা ২২ জন। এর মাঝে ক্ষুদ্রনৃগােষ্ঠী ১৫ জন (মহিলা সহ), বাঙালী ৭ জন। ক্ষুদ্রগােষ্ঠীদের মধ্যে (পুরুষ) ৫ জন চাকমা, ৩ জন মারমা, ২ জন ত্রিপুরা, ১ জন নির্বাচিত হবেন মুরং ও তংচঙ্গাদের মধ্যে থেকে এবং বাকী ১ জন নির্বাচিত হবেন লুসাই, বােম, পাংখাে, খুমী, চাক ও খিয়াং ক্ষুদ্রনৃগােষ্ঠীদের মধ্যে থেকে। ১৫ জন ক্ষুদ্রনৃগােষ্ঠী সদস্যদের মধ্যে ১ জন হবেন চেয়ারম্যান, ১২ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা। ৭ জন বাঙালী দের মধ্যে ৬ জন পুরুষ, ১জন মহিলা। আঞ্চলিক পরিষদের কাঠামােয় মহিলাদের সংখ্যা ৩ জন। বাঙালীরা তিন জেলা থেকে ২ জন করে নির্বাচিত হবেন। মহিলা ক্ষদ্রনৃগােষ্ঠীদের মধ্যে ১ জন চাকমা, বাকী ১ জন অন্য ক্ষুদ্রনৃগােষ্ঠী। পরিষদের সদস্যরা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের যারা পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হবেন। তিন পার্বত্য জেলার চেয়ারম্যানগণ পদাধিকার বলে পরিষদের সদস্য হবেন এবং তাদের ভােটাধিকার থাকবে। পরিষদের মেয়াদ হবে ৫ বছর এবং চেয়ারম্যান তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্যদের দ্বারা পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হবেন। আঞ্চলিক পরিষদ পার্বত্য এলাকায় ভারী শিল্পের লাইসেন্স প্রদান করবেন, স্থানীয় পরিষদগুলাের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করবেন আইন শৃঙ্খলা উন্নয়নে সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান করবেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা ও কর আদায় করতে পারবেন।
0 Comments