Hot Posts

6/recent/ticker-posts

রাজনীতি অধ্যয়নে গুরুতপূর্ণ গতানুগতিক পদ্ধতিসমূহ আলােচনা কর



রাজনীতি অধ্যয়নে গুরুতপূর্ণ গতানুগতিক পদ্ধতিসমূহ
বা ,
রাজনীতি বিশ্লেষণে গতানুগতিক পদ্ধতিগুলাে

গতানুগতিক পদ্ধতিসমূহ : গতানুগতিক পদ্ধতি কয়টি বা কোন কোন পদ্ধতি এর অন্তর্ভুক্ত এ নিয়ে আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। নিম্নে রাজনীতি অধ্যয়নের গুরুত্বপূর্ণ গতানুগতিক পদ্ধতিসমূহ সংক্ষেপে আলােচনা করা হলাে :

১. ঐতিহাসিক পদ্ধতি : রাজনীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। ঐতিহাসিক  পদ্ধতি বলতে সংগৃহীত তথ্য বা প্রমাণের ভিত্তিতে অতীত ঘটনাবলির বিশ্লেষণ এবং সাম্প্রতিক কালের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে সম্ভাব্য অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াকে বুঝায়। এর সাহায্যে অতীতের ঘটনাবলিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রাষ্ট্র, শাসনব্যবস্থা, আইন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎস্বরূপ নির্ধারণ করা যায়। এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিবর্তন কিভাবে হয়েছে তা অনুসন্ধান করা যায়। তাছাড়া রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ করা যায়। এজন্য অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ঐতিহাসিক পদ্ধতি গ্রহণের পক্ষে মত দিয়েছেন। এ পদ্ধতির সাহায্যে অতীত ও বর্তমানের তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব।

২. তুলনামূলক পদ্ধতি : রাজনীতি অধ্যয়নের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে তুলনামূলক পদ্ধতি। তুলনামূলক পদ্ধতি বলতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক অধ্যয়নকে বুঝায়। তুলনামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ অতীত ও বর্তমানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনা করে থাকেন। সাধারণত অতীত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে অনুরূপ বর্তমান প্রতিষ্ঠান, অতীত ঘটনার সাথে বর্তমান ঘটনা কিংবা একটি দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে অন্য দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য আলােচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। এসব দেশের সরকারের গঠন কাঠামাে এবং কার্যকলাপের মধ্যে তুলনা করে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভালাে খারাপ সম্পর্কে সহজে জ্ঞানলাভ করা যায়। এ কারণে অনেকে এ পদ্ধতিকে রাজনীতি অধ্যয়নের উৎকৃষ্ট উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

৩, প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি : রাজনীতি অধ্যয়নের একটি অন্যতম গতানুগতিক অথচ প্রত্যশাবাদী পদ্ধতি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি। প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি বলতে রাজনীতি অধ্যয়নের এমন এক দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝায় যা রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান অধ্যয়নের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যাখ্যাবিশ্লেষণের প্রচেষ্টা চালায়। এ পদ্ধতির সাহায্যে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অনুমােদিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঠামাে ও প্রকৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। বিশেষ করে রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক ও রীতিসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানসমূহের অধ্যয়ন করাই হচ্ছে এ পদ্ধতির অন্যতম লক্ষ্য। আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক কাঠামাে হিসেবে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ অধ্যয়নের মাধ্যমে যে কোন রাজনৈতিক বিষয়ের ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করা সম্ভব ফলে এ পদ্ধতিতে মনে করা হয়। 

৪. আনুষ্ঠানিক আইনমূলক পদ্ধতি : গতানুগতিক পদ্ধতিগুলাের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আইনমূলক পদ্ধতি একটি প্রভাবশালী পদ্ধতি। এটিকে শুধু আইনমূলক বা আইনগত পদ্ধতিও বলা হয়। এ পদ্ধতিকে আনুষ্ঠানিক আইনমূলক বলা হয়, কারণ এ পদ্ধতি সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানাদিকে আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারবিশ্লেষণ করে। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থাকে। আইনমূলক পদ্ধতি সাংবিধানিক ও সাধারণ আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ও সরকারি কাঠামাের গঠন, কার্যাবলি এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের আলােচনার উপর গুরুত্বারােপ করে। বিশেষ করে সরকারের আইনানুগ প্রতিষ্ঠান যথা : সংবিধান, আইনসভা, বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি আলােচনা করা হয়। এ পদ্ধতি রাজনীতির সাথে যুক্ত বিভিন্ন বিষয়াদির আলােচনাকে আইনানুগ কাঠামাের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী।

৫. বর্ণনামূলক পদ্ধতি : গতানুগতিক অধ্যয়ন পদ্ধতির মধ্যে বর্ণনামূলক পদ্ধতি খুবই উল্লেখযােগ্য। এ পদ্ধতিতে বিশেষ কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার নির্দিষ্ট কোন অংশের বিশদ বর্ণনা প্রদান করা হয়। এ পদ্ধতির সাহায্যে কোন প্রতিষ্ঠান বা ঘটনার বিশদ বর্ণনার মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। এজন্য এ পদ্ধতিকে আরােহমূলক পদ্ধতি বলা হয়। তবে এ পদ্ধতি বৈশিষ্ট্যগতভাবে ছিল বর্ণনাত্মক। বর্ণনামূলক পদ্ধতির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি দেশের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান অথবা কয়েকটি দেশের কতিপয় প্রতিষ্ঠানের আলােচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে বিশ্লেষককে সাংবিধানিক ও অন্যান্য কাঠামােগত বিষয়সমূহের বর্ণনার প্রতিই বেশি মনােনিবেশ দিতে দেখা যায়।

৬, দার্শনিক পদ্ধতি : রাজনীতি অধ্যয়নের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পদ্ধতি হলাে দার্শনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতি অনুসারে কতকগুলাে বিষয়কে পূর্ব অনুমানের ভিত্তিতে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয়া হয় এবং অবরােহ পদ্ধতিতে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে দার্শনিক পদ্ধতি হচ্ছে কাল্পনিক ও অনুমাননির্ভর। এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থার পর্যালােচনা অপেক্ষা কতকগুলাে পূর্ব সিদ্ধান্তের দ্বারা পরিচালিত হয়ে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক জীবনকে ব্যাখ্যা করা হয়। মানব চরিত্রের উপর ভিত্তি করে এ পদ্ধতির সাহায্যে রাষ্ট্রদার্শনিকগণ রাষ্ট্রের প্রকৃতি, প্রয়ােজনীয়তা, রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক ইত্যাদি বহুবিধ প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করেছেন। এ পদ্ধতিতে সাধারণত তিনটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় । যথা :
ক. অনুমান গ্রহণ,
খ, যুক্তি প্রদান ও,
গ, বিশ্লেষণ।

৭, পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি : রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযােগ কম থাকায় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ এ পদ্ধতির উপর নির্ভর করে থাকেন। পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ বৃহত্তর জগতের বাস্তব রাজনৈতিক জীবন এবং ঘটনাবলি লক্ষ্য করেন। এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াসমূহ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। 

৮. পরীক্ষণমূলক পদ্ধতি ; পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে কোন কিছু জানাকে পরীক্ষণমূলক পদ্ধতি বলে। সাধারণত তত্ত্ব বা মতাদর্শ অনুশীলনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনুসরণ ফলপ্রসূ। পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন কলাকৌশলের প্রয়ােগ নিয়ে নিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। নব্য স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের উপযুক্ত ধরনের সরকার ব্যবস্থা, সরকারের সাফল্যের কৌশল ইত্যাদি নিয়েও পরীক্ষণমূলক গবেষণা অনুশীলন করতে দেখা যায়। 

৯, সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি : রাজনীতি সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত হতে হলে সমাজতাত্ত্বিক অধ্যয়ন পদ্ধতি বিশেষভাবে প্রয়ােজন। এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা, শ্রেণি ও গােষ্ঠীর কার্যকলাপ, সমাজের পরিবর্তন প্রভৃতি বিশ্লেষণ করা যায়। বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমন অনেক বিষয় আছে যা আলােচনা করার জন্য অপরিহার্যরূপে সমাজবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। যেমন রাজনৈতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী, নির্বাচকমণ্ডলীর আচরণ, বিপ্লব ইত্যাদি।

১০. জীববিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রকে জীবদেহের সাথে তুলনা করে রাষ্ট্রের গঠন, বিকাশ, বিবর্তন ইত্যাদি ব্যাখ্যা করা হয়। এ পদ্ধতি অনুসারে রাষ্ট্রের পরিবর্তনশীলতাই এর ক্রমবিকাশ।

উপসংহার : উপযুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজনীতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গতানুগতিক পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়। গতানুগতিক পদ্ধতি কয়টি বা কোন কোন পদ্ধতি এর অন্তর্ভুক্ত এ নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। রাজনীতি অধ্যয়নে যেসব গতানুগতিক পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্যে উল্লিখিত পদ্ধতিগুলাে অন্যতম। মূলত রাজনীতি অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান সম্ভবপর নয়।

Post a Comment

0 Comments