Hot Posts

6/recent/ticker-posts

রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা আলােচনা কর।


রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে পরিসংখ্যানের গুরুত্বঃ

মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পরিসংখ্যানের ব্যবহারও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাচীনকালে যা কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয়কার্যে নীতি নির্ধারণে ব্যবহৃত হতাে, বর্তমানে মানবসমাজের রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিম্নে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণায় পরিসংখ্যানের গুরুত্ব সম্পর্কে আলােচনা করা হল ।



১, মানবকল্যাণ সাধন করে পরিসংখ্যানঃ বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা আবর্তিত হচ্ছে মানবকল্যাণকে কেন্দ্র করে। পরিসংখ্যান মানবকল্যাণের সাথে জড়িত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের প্রয়ােজনীয় পথ ও পন্থা নির্দেশ করে। পরিসংখ্যান বিদ্যমান দরিদ্র, বেকারত্ব, শিক্ষা, খাদ্য ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণা করে এবং মানবকল্যাণে এর সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় নির্ধারণ করে থাকে। আর এসব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সরকার পরিসংখ্যানের সাহায্য গ্রহণ করে থাকে।

রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের নিয়ন্ত্রণ ও তদারক করে পরিসংখ্যানঃ পরিসংখ্যান রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকে ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রীয় কোন কর্মকাণ্ডের অগ্রগতি, ফলাফল সংখ্যাত্মক তত্ত্বের মাধ্যমে উপস্থাপনের প্রয়োজন হয়, এক্ষেতে পরিসংখ্যান সাহায্য করে থাকে। 

৩. রাষ্ট্রীয় আদর্শের বাস্তবায়নে পরিসংখ্যানঃ রাষ্ট্রীয় আদর্শ বাস্তবায়নে পরিসংখ্যানের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। গণমুখী ও বাস্তব আদর্শ সমন্বিত রাজনীতির ক্ষেত্রে সামাজিক পরিসংখ্যানের ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। আর এ গণমুখী ও বাস্তব আদর্শ সমন্বিত রাজনীতি দেশে সার্বিক কল্যাণসাধন করতে পারে। সুতরাং আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কল্যাণমুখী আদর্শের বাস্তবায়নে সামাজিক পরিসংখ্যান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।


৪. প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের সহায়ক পরিসংখ্যানঃ  রাষ্ট্রের প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণে পরিসংখ্যান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- রাষ্ট্রের বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন, আমদানি-রপ্তানি নীতি প্রণয়নে পরিসংখ্যানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া শস্য উৎপাদন নীতি, মুদ্রার মান নির্ধারণ, বাণিজ্য নীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
 ৫. রাজনীতি বিষয়ক গবেষণায় পরিসংখ্যানঃ  রাজনীতি বিষয়ক গবেষণায় পরিসংখ্যান ব্যবহৃত হয়। আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের হ্রাস-বৃদ্ধি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিমাপের ক্ষেত্রে গবেষণামূলক পর্যালােচনায় পরিসংখ্যান ব্যবহৃত হয়। 

৬. জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিসংখ্যানঃ  যে কোন দেশের উন্নতির জন্য প্রয়ােজন বাস্তবসম্মত জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন। জীবনযাত্রার মান, শিক্ষার হার, দারিদ্র বিমােচন ইত্যাদির নির্ভূল তথ্যাবলি বিশ্লেষণের জন্য পরিসংখ্যানের নানা পদ্ধতির ব্যবহার একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মূলত পরিসংখ্যান রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সমস্যাগুলাে উপলব্ধি করে প্রয়ােজনীয় ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে। এছাড়া পরিসংখ্যানের দ্বারা পরিকল্পনায় সাফল্য ও ব্যর্থতাও পরিমাপ করা যায় ।

৭  রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিমাপে পরিসংখ্যানঃ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিমাপে পরিসংখ্যানের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যােগান, চাহিদা, উৎপাদন, বণ্টন, অর্থের মান, সুদের হার, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিষয়গুলাের চিত্র ও ব্যাখ্যা পরিসংখ্যানের মাধ্যমেই জানা যায়। এছাড়া এসব বিষয়ের গবেষণার ক্ষেত্রেও পরিসংখ্যান সাহায্য করে থাকে।

৮. রাজনৈতিক অবস্থার চিত্র প্রদর্শন করে পরিসংখ্যানঃ পরিসংখ্যানের মাধ্যমে একটি দেশের রাজনৈতিক অবস্থার চিত্র প্রদর্শন করা যায়। বর্তমান সরকার ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও সফলতার দিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উপস্থাপনা পরিসংখ্যানের মাধ্যমে পাওয়া যায়। 

৯, রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে দিক নির্দেশনাঃ  পরিসংখ্যান রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে দিক নির্দেশনা প্রদান করে। বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা খুবই পরিবর্তনশীল। এজন্য দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোন কিছু সম্পাদন করতে হলে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে করতে হয়। আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুমান করতে হলে অতীতের ঘটনাবলি নিয়ে গবেষণার প্রয়ােজন হয়। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান এ গবেষণায় সাহায্য করে।
১০্‌ রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নে পরিসংখ্যানঃ রাষ্ট্রীয় আইন কার্যকরী ও বাস্তবমুখী করতে হলেও তা প্রণয়নে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এজন্য নির্ভুল পরিসংখ্যানিক তথ্য একান্ত অপরিহার্য ।রাষ্ট্রীয় আইনের সার্থক প্রয়োগ নির্ভর করে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ এবং তার বিশেষণ প্রয়োজনীয়তা নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ প্রভৃতির উপর। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।




পরিসংখ্যানের সীমাবদ্ধতা (Limitations of Statistics) বর্তমানে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য পরিসংখ্যানের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু, তারপরেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পরিসংখ্যানের উপর সম্যক ধারণা রাখার জন্য এর সীমাবদ্ধতাও জানার প্রয়ােজন আছে। এর সীমাবদ্ধতা হলঃ 

 ১, পরিসংখ্যান গুণবাচক তথ্য নিয়ে আলোচনা করে নাঃ পরিসংখ্যানে যে তথ্যের প্রকাশ করা হয় সেটা সংখ্যাবাচক, গুণবাচক নয়। কেননা, কোন বিষয় সম্পর্কে সহজে ধারণা লাভের জন্য গুণের চেয়ে সংখ্যা বেশি কার্যকরী  ভূমিকা রাখে। এটি পরিসংখ্যানের একটি বড় সমস্যা। 
 ২. পরিসংখ্যানে কোন তথ্যকে সংখ্যায় প্রকাশ করতে হয়ঃ  সংখ্যার মাধ্যমে কোন বিষয় সম্পর্কে  সুচিন্তিত ধারণা পাওয়া যায় এটা সত্য, কিন্তু এমন বিশেষ কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে তথ্য প্রকাশে সংখ্যার চেয়ে গুণের ভূমিকা বেশি থাকে।

৩, ইচ্ছাকৃত অপব্যবহারঃ অনেক সময় পরিসংখ্যানে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য প্রদান করা হয়। এতে অনেক সময় কারও কিছু করার থাকে না। যেমন- কোন বক্তব্যে রিপাের্টে প্রকৃত অবস্থা না জানিয়ে নিজের সুবিধাথে অন্য তথ্য প্রদান করা।

৪. পরিসংখ্যান একটি বিষয়কে আলােচনা করে নাঃ পরিসংখ্যানে যেহেতু বিভিন্ন তথ্যের সমন্বয় থাকে তাই এটি একটি বিষয়কে নিয়ে আলােচনা করতে পারে না। সমষ্টির উপর গবেষণা চালায় এবং সে অনুযায়ী ফল প্রদান করে। কোন  গােষ্ঠীর নির্দিষ্ট একক জানতে চাইলে পরিসংখ্যান সেটি দিতে পারে না।

৫. সমগ্র নিয়ে আলােচনা করলেও সমগ্র ধারণা দিতে পারে নাঃ  পরিসংখ্যান একটি গােষ্ঠীর সমগ্র বিষয় নিয়ে আলােচনা করলেও সমগ্ৰ তথ্য দিতে পারে না। কেননা এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলাে পরিসংখ্যানের গবেষণায় ব্যবহৃত হয় না। 

৬. পরিখ্যান পুঞ্জীভূত বিষয়কে আলােচনা করেঃ পরিসংখ্যান পুঞ্জীভূত বিষয়কে নিয়ে আলােচনা করে বলে অনেককিছু বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশ করতে পারে না। একটি দেশের মাথাপিছু আয় আলােচনায় দেশের সমগ্র জনগণকে বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকে কোন উপার্জনই করে না বরং শুধু ব্যয় করে, কিন্তু তারপরেও তার একটা জাতীয় মাথাপিছু আয় দেওয়া হয়। বৈদেশিক ঋণ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে। 
৭, পরিসংখ্যানের ফলাফল বিভ্রান্তিজনকঃ  পরিসংখ্যানের গবেষণায় কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়। ঘটনাকে পুঞ্জীভূত করা হয়। এসব কারণে পরিসংখ্যানের ফলাফল বিভ্রান্তিজনক। একজন ছাত্র প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় পরিসংখ্যানে ৫০ নম্বর, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় ৬০ নম্বর, বার্ষিক পরীক্ষায় ৭০ নম্বর পেল। অপর একজন ছাত্র প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ৭৫ নম্বর, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় ৬৫ নম্বর এবং বার্ষিক পরীক্ষায় ৪০ নম্বর পেল। দু'জন ছাত্রের পৃথকভাবে গণনায় মােট নম্বর সমান। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যানে বলা হয় দু'জন ছাত্রই সমান। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রথম ছাত্রটি ক্রমান্বয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে এবং দ্বিতীয় ছাত্রটি ক্রমান্বয়ে কম নম্বর পেয়েছে।



৮. পরিসংখ্যান বিধিগুলাে শুধুমাত্র দীর্ঘমেয়াদি সূত্রে সত্যঃ  পরিসংখ্যানের বিধিগুলাে নিয়ত পরিবর্তনশীল। অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মত এটি অপরিবর্তনীয় নয়। পরিসংখ্যান কোন তথ্যকে গড়, আসন্নমান, সম্ভাব্যতায় প্রকাশ করে।

৯. পরিসংখ্যানের পদ্ধতিগুলাে কোন ঘটনা পর্যালােচনার একটি পদ্ধতিমাত্রঃ কোন বিষয়কে জানার জন্য অনেকগুলাে পদ্ধতি থাকতে পারে। পরিসংখ্যান সে অনেকগুলো পদ্ধতির একটি মাত্র। পরিসংখ্যান কোন বিষয়ের একটি মােটামুটি নির্ভরযােগ্য তথ্য প্রদান করে। পরে এটি অন্যান্য পরিপূরক মানের সাহায্যে প্রমাণের প্রয়ােজন হয়। 
১০, পরিসংখ্যান কোন বিষয় জানার জন্য মালমশলা যােগায়ঃ কোন বিষয় জানার জন্য পরিসংখ্যান প্রয়ােজনীয় মালমশলা পর্যন্ত যােগান দিতে পারে। কোনকিছুর ভিত্তিমূল রচনার জন্য এগুলাে ব্যবহৃত হয় মাত্র। কেননা, কোন বিষয়ের উপর সামগ্রিক (নির্দিষ্ট) ধারণা প্রদান পরিসংখ্যানের মাধ্যমে সম্ভব নয়।



উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলােচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে পরিসংখ্যানে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা দক্ষতার সাথে দূর করার মাধ্যমে একে ব্যবহার উপযােগী করে তােলা যায়। মানব উন্নয়নের বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। পরিসংখ্যানের বিভিন্ন তত্ত্ব ও পদ্ধতিসমূহ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা মানবকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাচ্ছে। এজন্য বর্তমানে পরিসংখ্যানকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

Post a Comment

0 Comments