পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। পাকিস্তান সরকার এ যৌক্তিক দাবির সম্পূর্ণ বিরােধিতা করে ১৯৪৮ সালেই উর্দুকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘােষণা করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ চলতে থাকে যা পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত হয় ১৯৫২ সালে এবং সেই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছাত্ররা একত্রিত হয়। পুলিশ এ জনসমাবেশের উপর গুলি চালানাের ফলে রফিক, সালাম, বরকত, জববারসহ আরাে অনেকে শহীদ হয়। এই ঘটনা আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দান করে এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। ১৯৫৬ সালে চূড়ান্তভাবে সংবিধানে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম প্রধান জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ভাষা আন্দোলন প্রেক্ষাপট
ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে চূড়ান্ত পরিণতি পেলেও এটি ধারাবাহিকভাবে গড়ে ওঠা একটি আন্দোলন ছিল। রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান জন্মলাভের আগে থেকেই ভাষা নিয়ে পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবী মহল কথা বলতে শুরু করেছিলেন। পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে ভাষা আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত সংগ্রামের রূপ লাভ করে। ১৯৪৭ সাল থেকেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্রব এবং তার প্রতিবাদও শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ২সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় তমদ্দুন মজলিশ। এই সংগঠন বিভিন্নভাবে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করছিল। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হন শামসুল আলম। ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারাদেশে ধর্মঘট আহ্বান করেন। আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে ৪৮ সালের ১৫ মার্চ আলােচনায় বসতে বাধ্য হন এবং সেখানে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে দুবার ২১ মার্চ এবং ২৪ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােঃ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা দিলে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী বাংলা ভাষাকে আরবিকরণের উদ্যোগ নিলে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়। এভাবেই ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আন্দোলন চলছিল।
ভাষা আন্দোলনের শহীদ
২১ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ঠিক কতজন মারা গিয়েছে তা নিয়ে পরবর্তীকালে নানা কারণে মতভেদ দেখা দিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি লেগে কেউ আবার পরে মৃত্যুবরণ করেছেন। শেষপর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া গেছে ভাষার কারণে ৬ জন শহীদ হয়েছিলেন। শহীদ রফিকউদ্দীন আই.কম, পড়তেন। তাঁর বয়স উনিশ/বিশ ছিল। তার বাড়ি মানিকগঞ্জ। আবুল বরকত ১৯২৭ সালের ১৬ জুন জন্মগ্রহণ এবং ১৯৪৫ সালৈ ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পাকিস্তানে আসেন। তাঁর পিতার নাম শামসুজ্জোহা। শহীদ শফিউর রহমান ছিলেন হাইকোর্টের কর্মচারী। ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তার জন্ম। এঁদের তিনজনকেই আজিমপুর দাফন করা হয়। শহীদ আব্দুল জব্বার ছিলেন পেশায় দর্জি। গফরগাঁওয়ের পাচাইয়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। শহীদ অলিউল্লাহর বয়স ৮/৯ বছর। তিনি রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে। আবদুস সালাম ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ এপ্রিল মারা যান। তিনি পেশায় পিয়ন ছিলেন।
আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে এটি ছিল বাঙালি জাতির প্রথম বিদ্রোহ। ভাষা আন্দোলন তৎকালীন রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। ১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ: ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার মর্যাদার জন্যই গড়ে ওঠেনি। পাকিস্তানের মাত্র ৭.২% জনগণ ছিল উর্দু ভাষাভাষী। পক্ষান্তরে ৫৪.৬% জনগণের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা বাঙালি স্বভাবতই মেনে নিতে চায় নি।এর সাথে তাদের জীবিকার্জনের প্রশ্নও জড়িত ছিল। এমনিতে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই জনসংখ্যার সংখ্যাধিক্য বিষয়টি অমান্য করে পশ্চিম পাকিস্তানে রাজধানী, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু স্থাপিত হয়। শাসকদের ভাষা উর্দুকেই তাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বেছে নেয়ায় বাঙালিদের চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরাে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল রাজনীতিসহ সর্বত্র বাঙালিকে বঞ্চিত করার পশ্চিমা মানসিকতা। তাই ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে মুসলিম লীগের মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সন্দিহান করে তােলে। অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায় হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠাকে তারা বেছে নেয়। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাই ষাটের দশকে স্বৈরশাসন বিরােধী ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে আন্দোলনে প্রেরণা জোগায়।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ:
অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ:
ভাষা আন্দোলনের ফলে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার আন্দোলন শুরু করে।
জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা:
জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা:
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী মহলে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৯৫২ সালের আন্দোলন ব্যাপক জনগণের মধ্যে প্রভাব ফেলে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিস্থিতি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনায় তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে পরের দিনের গায়েবানা জানাজার পর ঢাকা শহরের পরিস্থিতির ওপর কারাে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কারাে নির্দেশ ছাড়াই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মহল্লা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্বতঃস্ফুর্ত মিছিল রাজপথে নেমে পড়ে। পুলিশের সাথে জনতার বহু স্থানে সংঘর্ষ হয়। সারা ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহর ছিল প্রতিবাদ, মিছিল আর হরতালের শহর। ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর মফস্বলে ছড়িয়ে পড়লে সেখানেও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। প্রতিটি সভায় গণপরিষদ সদস্যদের পদত্যাগ, হতাহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, বিচার দাবি করা হয়। যেসব এলাকায় আন্দোলন তীব্র ছিল সেগুলাে হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনিসংহ, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী, পাবনা, যশাের প্রভৃতি শহরে। আন্দোলন শুধু শহরে নয় গ্রামে-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। গঠিত হয় সংগ্রাম কমিটি। এই আন্দোলনে ঢাকার মতােই এই প্রথম কৃষক, শ্রমিক মেহনতি মানুষ যুক্ত হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক বদরুদ্দীন উমর জোর দিয়ে বলেছেন, “পূর্ববাংলা কৃষক, শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশায় নিয়ােজিত মেহনতি জনগণের সকল অংশ এ আন্দোলনে যতখানি ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, ততখানি অন্য কোথাও নয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রকল্পের “ভাষা আন্দোলন ও অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণী অবস্থান গবেষণা গ্রন্থেও একই মত পােষণ করা হয়েছে।
স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা:
স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা:
ভাষা আন্দোলন ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও ক্রমে এর সাথে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন জড়িত হয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনকালে ও পরে বিভিন্ন লেখনি ও দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু বাংলাভাষা নয় বরং বাঙালিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন দাবি উত্থাপিত হয় । গণপরিষদে পূর্ববাংলার জনসংখ্যানুপাতিক আসন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালি নিয়ােগ, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান ঘটানাের দাবি করা হয়। যুক্তফ্রন্ট এসব দাবিকে প্রথম জনসমক্ষে নিয়ে আসে। যা ষাটের দশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবিতে পরিস্ফুটিত হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে রূপ নেয়। স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে যা চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করে। তাই বলা যায় যে, ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি স্তরে প্রেরণা যুগিয়েছে ভাষা আন্দোলন।
0 Comments