পররাষ্ট্রনীতি বলতে কি বুঝ? পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক উপাদানসমূহ আলোচনা কর।



পররাষ্ট্রনীতির সংজ্ঞা

Meaning and Definition of Foreign Policy

একটি সরকার বিভিন্ন উদ্দেশ্য লাভের জন্য বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এ বিভিন্ন উদ্দেশ্য যেমন পরস্পরবিরােধী হতে পারে না, তেমনি বিভিন্ন নীতির মধ্যেও একটি সামঞ্জস্য, স্বাভাবিক। দেশের নিরাপত্তা রক্ষা ও উন্নতি সাধনের প্রয়ােজনে বিভিন্ন উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি সরকার অনুসরণ করে চলে তাকেই জাতীয় নীতি (National policy) বলা যায়। এ জাতীয় নীতিকে মােটামুটিভাবে দুই অংশে ভাগ করা চলে— অভ্যন্তরীণ নীতি ও বৈদেশিক নীন , যে নীতি রাষ্ট্র নিজের ভূখণ্ডে নিজের শক্তি ও সম্পদ দ্বারা অনুসরণ করতে পারে তাকে আমরা অভ্যন্তরীণ নীতি বলি, কিন্তু যে নীতি অনুসরণ করতে হলে অন্য রাষ্ট্রের সাহায্য সহায়তা প্রয়ােজন হয় বা যে নীতি অন্য রাষ্ট্রের মতিগতির উপর নির্ভরশীল তা পররাষ্ট্রনীতি বলে পরিচিত। অভ্যন্তরীণ নীতি ও বৈদেশিক নীতি আসলে একই জাতীয় নীতির দুই রকম প্রকাশ মাত্র। তাই এ দুই নীতিকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করে বিবেচনা করা উচিত নয়। একই সরকার এ দুই নীতিই পরিচালনা করে থাকে। এ দুই নীতির উদ্দেশ্যও অভিন্ন দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করা, দেশের উন্নতি সাধন করা, এক কথায় জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি রাষ্ট্রই একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আর এর মাধ্যমেই প্রতিটি রাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থ অর্জন ও সুসংরক্ষিত করতে বদ্ধপরিকর। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আদর্শগত বা বস্তুগত যে স্বার্থেই হােক না কেন তার বাস্তব রূপদানে নীতি বা পদ্ধতি আবশ্যক। আবার সে নীতি পদ্ধতি অবশ্যই সুসংবদ্ধ, সুশৃঙ্খল, নির্দিষ্ট এবং আন্তর্জাতিক আইনসম্মত হতে হবে। বৈদেশিক নীতি বলতে বিদেশের সাথে সম্পর্কের সকল দিক এবং তার সাথে পরিকল্পনা প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রূপায়ণ মিলেই একটি সমন্বিত প্রয়াসকে বুঝায়। এটা হলাে ব্যাপক অর্থে পররাষ্ট্রনীতি। আর সংক্ষিপ্ত বা সংকীর্ণ অর্থে কেবল রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত কার্যকলাপকেই পররাষ্ট্রনীতি বলা হয়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতগণ অত্যন্ত গুরুগম্ভীর ভাষায় এবং জটিল কঠিন উপাদানের অবতারণার মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সংজ্ঞাসমূহ নি উল্লেখ করা হলাে :


• প্রশিয়ার বিশিষ্ট রাজনীতিক ও কূটনীতিবিদ প্রিন্স অটেন বিসমার্ক (Bismarck) যথার্থই বলেছেন, "The extension of domistic policy is foreign policy." অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ নীতির সম্পসারণ পররাষ্ট্রনীতি।

• শ্লেচার (Schleicher) বলেন যে, “বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যে পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম গ্রহণ করে তাকেই পররাষ্ট্রনীতি বলা হয়। যেমন একটা রাষ্ট্র অর্থনীতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক বা অন্য যে কোন বিষয়ে যে কোন নীতি অনুসরণ করতে পারে এবং এটাই সে দেশের পররাষ্ট্রনীতির আখ্যা পাওয়ার যােগ্য।”

রাসেট ও স্টার (Russett and Star)-এর মতে, “রাষ্ট্র সীমানার বাইরে অর্থাৎ অন্য রাষ্ট্রের জনগণ, স্থান ও কর্ম সম্পর্কে যে পথ নির্দেশ সেটিই পররাষ্ট্রনীতি।”

হার্টম্যান বলেছেন যে, “দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রাষ্ট্র যে বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন নীতি অনুসরণ করে তাকেই পররাষ্ট্রনীতি বলা হয়।”



পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের উপদানসমূহ।

Determinant Factors of Foreign Policy

পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকরূপে কতিপয় অনিবার্য উপাদান রয়েছে । বস্তুত জাতীয় শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে ক্রিয়াশীল। আর যে সকল বিষয়ের উপর ভিত্তি পররাষ্ট্রনীতিসমূহ প্রণয়ন করা হয় সেগুলােকে বৈদেশিক নীতির নির্ধারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, একটি রাষ্ট্রের শক্তি, সামর্থ্য, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য আন্তর্জাতিক পরিবেশ পরিস্থিতি, আদর্শগত অবস্থান প্রভৃতি হলাে সেই নিয়ামক শক্তি। তবে স্থান-কাল-পাত্র এবং পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির আলােকে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে ভিন্ন ভিন্ন নীতি গৃহীত হয়ে থাকে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাষ্ট্র মাত্রই আন্তর্জাতিক পরিবেশে আপন স্বার্থে ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে থাকে। যেখানে কোন বিশেষ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাস ও সর্বাঙ্গীণ বাস্তব পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি বর্তমানের । প্রয়ােজনীয় বিষয়াদির গুরুত্বের ক্রমানুসারে তা নির্ধারণ করা হয়। সকল দেশের জন্য এক ও অভিন্ন নীতি গ্রহণের প্রশ্নই অবান্তর। তাই সমুদয় দিক বিবেচনায় রেখে যে সকল বিষয়কে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে অধিকতর গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয় সেগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে :


১। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও সামর্থ্য
(Power and Capability of State) : পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে প্রণেতাগণ তার দেশের ক্ষমতা ও সামর্থ্যের উপর বিশেষ ধারণা রাখেন। লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সামর্থ্যের সামঞ্জস্য বিধানের উপরই পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য বা স্বার্থকতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। এতদুভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে।


২,প্রাকতিক ও ভৌগােলিক পরিস্থিতি (Natural and Geographical Conditions) রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে রাষ্ট্রের ভৌগােলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সুযােগ সুবিধা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লালন করে থাকে। রাষ্ট্রের ভৌগােলিক পরিবেশ এবং তার অবস্থানের সামরিক রাজনৈতিক গুরুত্ব এ দ্বিবিধ দিক থেকে তা পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবান্বিত করে। একটি রাষ্ট্রের ভৌগােলিক পরিবেশ বলতে বুঝায় সে রাষ্ট্রের আয়তন, ভূক্তভাগ, জলবায়ু প্রভৃতিকে। কতকগুলাে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের রিপ্রেক্ষিতে কোন রাষ্ট্রের ভৌগােলিক পরিবেশকে আদর্শ পরিবেশ হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। যেমন ঃ

(ক) রাষ্ট্রের আয়তন এমন হওয়া উচিত, যাতে রাষ্ট্রের অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান যথাযথভাবে বজায় থাকে;

(খ) রাষ্ট্রের জলবায়ু কঠোর শ্রমের অনুকূলে হওয়া উচিত।

(গ) রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক বিন্যাস যেমন ঃ পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র বেষ্টিত রাষ্ট্রসমূহ যা বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধে রাষ্ট্রকে সাহায্য করে এমন ভৌগােলিক অবস্থান;

(ঘ) সাবেকি যুদ্ধাবস্থায় নিজকে রক্ষা করার মত রাষ্ট্রের প্রয়ােজনীয় আকৃতি।

ভৌগােলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বলা চলে গ্রেট ব্রিটেন একটি আদর্শ অবস্থানে রয়েছে। সাগর পথে প্রায় সমগ্র বিশ্বের সাথে তার যােগাযােগকে অত্যন্ত সুবিধাজনক করে দিয়েছে। আর এ সাগরকে ব্যবহার করেই রাষ্ট্রটি একদিন বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়েছিল। আবার ইউরােপ থেকে আমেরিকা নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে মধ্যবর্তী মহাসাগর দিয়ে।


একটি দেশের বৈদেশিক ও নিরাপত্তা নীতি (Defence Policy) নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই দেশের মালিক অবস্থান, আয়তন, প্রতিবেশী দেশের সাথে সীমারেখা প্রভৃতি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতেই হবে। ভারতবর্ষের কোন সরকারই হিমালয় ভারত মহাসাগর বা ভারত-পাকিস্তান কন্তরেখার গুরুত্ব অগ্রাহ্য করে বৈদেশিক নীতি স্থির করতে পারে না। আফগানিস্তানের ভৌগোলিক সামরিক অবস্থানহেতু আফগানিস্তান বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আফগানিস্তানে প্রাধান্য বিস্তারের মাধ্যমে কোন রাষ্ট্র সহজেই মধ্যপ্রাচ্য, পাক-ভারত উপমহাদেশ, রাশিয়ার এশিয়ার অংশ এবং চীনের মধ্যে আক্রমণের আশঙ্কা সৃষ্টি করতে পারে। ভৌগােলিক অবস্থানহেতু অনেক রাষ্ট্রের সামরিক গুরুত্ব নির্ধারণ করা হয়।


৩। সামরিক শক্তি ও সামর্থ্য (Military Power and Capability) ও সামরিক শক্তির প্রভাব পররাষ্ট্রনীতিতে সুস্পষ্টভাবেই অনুমেয়। আপন এবং বন্ধু বা শত্রু রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বিবেচনা করেই একটি দেশের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করতে হয়। সে জন্য সামরিক শক্তিতে বলীয়ান রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির প্রকৃতি ভিন্ন রকমের হয়। উদাহরণস্বরূপ এবং প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভারত বাংলাদেশের সাথে বরাবর যে Big brotherly attitude প্রদর্শন করে আসছে তার একটি অন্যতম প্রভাব ভারতের সামরিক শক্তির বড়াই। তাই শেখ হাসিনা সরকার রাশিয়া থেকে মিগ-২৯ ক্রয়ে আগ্রহী হয়, যাতে ভারত সর্বসাধ্য দিয়ে বাধা প্রদান ও বিশ্ব জনমত গঠনের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল। কারণ বাংলাদেশের এ সামরিক শাক্ত অজনকে ভারত তার স্বার্থের প্রতি হুমকিস্বরূপ মনে করেছিল। নতুবা ফারাক্কাসহ বিভিন্ন নদীর পান বন, বাণিজ্য ঘাটতি, পরােক্ষ ও প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক শােষণের ধারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

৪. অর্থনৈতিক পরিস্থিতি (Economic Condition) ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিটি রাষ্ট্রই অন্য রাষ্ট্রের উপর কমবেশি নির্ভরশীল। অনেক রাষ্ট্রকেই বিদেশ থেকে খাদ্য, কাঁচামাল বা যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। আবার দেশের চাহিদার বেশি উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানি করতে হয়। ফলে সকল রাষ্ট্রেরই ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রয়ােজন অনস্বীকার্য। এশিয়া-আফ্রিকার নতুন রাষ্ট্রগুলাের বিদেশী সাহায্যের প্রয়ােজন রয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক মতবাদ যাই হােক না কেন বৈদেশিক নীতি। নিধারণের সময় সমস্ত সরকারকেই এ অর্থনৈতিক প্রয়ােজনের কথা স্মরণ রাখতেই হয়। অর্থনৈতিক শক্তিই কোন রাষ্ট্রের সকল প্রকার শক্তির প্রধান নিয়ামক। যে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামাে যত দ্য বহিঃবিশ্বে সে.রাষ্ট্র তত শক্তিশালী ও সম্মানিত। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ ধনী রাষ্ট্রগুলাের কথা উল্লেখ করা যায়।


৫, রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ (State Ideology) ঃ এক এক রাষ্ট্রের মতাদর্শ এক এক রকম। ফলে রাষ্ট্রসমূহের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যেকার পার্থক্য বিধানে এ আদর্শিক পার্থক্য লক্ষণীয় প্রভাব রাখে। কারণ আপন রাষ্ট্রের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং অন্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতেই একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা জরুরি। এটি শতাব্দীকালের পুরনাে নিয়ামক হিসেবে পররাষ্ট্রনীতিতে স্থান পেয়ে আসছে। অধুনা প্রতিটি রাষ্ট্রই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুসরণ করে চলছে। পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ ভিন ভিন ধরনের রাষ্ট্রীয় তথা রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী। তাদের মধ্যকার আদর্শ, মূল্যবোেধ, নীতিমালা উদ্দেশ্য লক্ষ্য কর্মসচি তাদের নিজস্ব মতাদর্শ দ্বারা। পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে এর ভিত্তিতে রাষ্ট্রগুলাের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিমালা। সেভাবেই প্রণীত হয়।

৬। ইতিহাস ও ঐতিহ্য (History and Traditions) ঃ কোন দেশের পররাষ্ট্রনীতির উপর সে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রভাব সমানভাবে পরিলক্ষিত হয়। সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরােধিতা এশিয়া ও আফ্রিকার সমস্ত নতুন রাষ্ট্রগুলাের বৈদেশিক নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ . বৈশিষ্ট্যের মূলে আছে ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য। গণতান্ত্রিক দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের উপর বা শ্রেণী অর্থ বা আঞ্চলিক স্বার্থের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হয়। বৈদেশিক নীতি যারা নির্ধারণ করেন তারা বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মতামতের মধ্যে যতদূর সম্ভব সামঞ্জস্য স্থাপন করে তাদের নীতি স্থির করার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন মতের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করে জাতীয় স্বার্থ সম্বন্ধে একটি সাধারণ ধারণা সৃষ্টি করা সহজ নয়, কিন্তু বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এ সাধারণ ধারণা সৃষ্টি করা বিশেষ প্রয়ােজন।


৭। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রভাব (Effect of Internal Politics) ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। একটি দেশের জনমত দ্বারা সেই দেশের বৈদেশিক নীতি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। দেশের মধ্যে জনসাধারণের অসন্তোষ যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন অনেক সময় সরকার বৈদেশিক ব্যাপারে এমন নীতি গ্রহণ করার চেষ্টা করে যাতে জনসাধারণের দৃষ্টি সেই দিকে আবদ্ধ হয়ে যায়। সােভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে খুশ্চেভ এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভিতর যে সংঘাত চলছিল তার সাথে। হাঙ্গেরিতে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত হস্তক্ষেপের নিকট সম্পর্ক ছিল বলে অনেকে মনে করেন। সেভাবে অনেকের ধারণা যে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ভারত গােয়াতে যে সামরিক অভিযান প্রেরণ করে তার। সাথে কৃষ্ণ মেননের নির্বাচনী প্রচার যুক্ত ছিল। কৃষ্ণ মেনন তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি নিজেই এ অভিযান প্রেরণের সব ব্যবস্থা ঠিক করেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু পর্যন্ত এ বিষয়ে সঠিক কিছুই জানতেন না। এ ভাবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব অনেক সময়ই পররাষ্ট্রনীতির উপর প্রভাব ফেলে। তবে তা সবসময়ই জনসাধারণের কাছে প্রকাশিত বা স্পষ্ট হয় না।

৮। সরকারের দক্ষতা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধরন (Efficiency of Govt. and Type . of Political Leadership) ও রাষ্ট্রীয় সরকারের দক্ষতা, নেতৃত্বের সামর্থ্য কৌশল প্রণয়নের বুদ্ধিমত্তা দূরদর্শিতার উপর সে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বহুলাংশেই নির্ভরশীল। বস্তুত এগুলাে। পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের বীজস্বরূপ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি কুশলী, দক্ষ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়, তবে তারা সময়ােপযােগী বৈদেশিক নীতি গ্রহণে সফলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন। সরকারের প্রতি গণসমর্থন, রাষ্ট্রের সুসংবদ্ধ প্রশাসনিক কাঠামাে, তথ্য সগ্রহ ও বিন্যাসে সরকারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, পররাষ্ট্র দপ্তরে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের যােগ্যতা, পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও পররাষ্ট্র বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহের উপর প্রভাব বিস্তার করে।


৯। সমসাময়িক বিশ্ব পরিস্থিতি (Contemporary World Condition) : একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সমসাময়িক আন্তর্জাতিক সমাজ ও রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল।


১০। ভাবমূর্তিঃ পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে অনেক সময়ই সঠিক তথ্যের উপর নির্ভর না করে অন্য দেশের ভাবমূর্তির উপর নির্ভর করেই একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি প্রণীত হয়ে থাকে। অন্য দেশের উদ্দেশ্য ও নীতি সম্বন্ধে আমাদের যে সাধারণ ধারণা থাকে তাকেই সে দেশের সম্বন্ধে অন্যের ভাবমূর্তি বলে। যেমন : পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রদ্বয়ের পরস্পর পরস্পরের ভাবমূর্তি হল একে অপরের শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্র। ফলে তাদের একটি দেশ যাই করুক না কেন অপর দেশটি কত বিচার বিশ্লেষণ না করেই ধরে নেবে কাজটি তার জন্য শত্রুতামূলক এবং স্বার্থবিরােধী। এ ঘটনা বা পরিস্থিতি সম্বন্ধে কোন রাষ্ট্রনায়কের মনে যদি বিশেষ কোন ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়ে তবে তিনি প্রধানত সেই ভাবমূর্তি দ্বারা পরিচালিত হয়ে সমস্ত তথ্যকে সেই ভাবমূর্তির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করে নীতি নির্ধারণের চেষ্টা করেন।

১১। কূটনীতির গুণগত মান (Qualitative Standard of Diplomacy) : পররাষ্ট্রনীতির প্রণয়ন ও কার্যকরীকরণে কূটনীতির এক বিশেষ ও অনস্বীকার্য অবদান সর্বজনবিদিত। ফলে কূটনৈতিক কৌশলের গুণগত মানের উপর কোন একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অনেকাংশেই নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক সমাজে কোন একটি রাষ্ট্রের সম্মান, মর্যাদা, সাফল্য, ব্যর্থতা, সব কিছুই সে দেশের প্রায়ােগিক কূটনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব ও কৌশলের উপর নির্ভরশীল। উদ্ভূত কোন পরিস্থিতিকে চাতুর্যপূর্ণ উপস্থাপনা ও কুশলী প্রয়ােগের মাধ্যমে সমাধান করতে পারা কূটনীতির একটি বৃহৎ . দায়িত্ব। রাষ্ট্রের কূটনীতিকগণই জাতীয় লক্ষ্য উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দেন। যে দেশের কূটনৈতিক মেধা যত উন্নত তার সাফল্য অর্জনের পরিমাণও ততবেশি। ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন, মতপার্থক্য বা বিবাদের সমাধান বা মীমাংসা প্রভৃতি কূটনীতিকদের কর্মকাণ্ডের আওতাভুক্ত। দক্ষ অভিজ্ঞ ও মেধাবী কূটনীতিকগণের দ্বারাই উন্নত রাষ্ট্রগুলাে তাদের শক্তিশালী ও কার্যকর পররাষ্ট্রনীতি চর্চা করে থাকে, ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সর্বদা এগিয়ে থেকে তারা অত্যন্ত দূরদর্শিতার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনুন্নত দেশসমূহে কূটনৈতিক ব্যর্থতার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। কূটনীতিকগণ দলীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন বিধায় জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ বা পরিচালনা করেন না। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতাহেতু অনুন্নত দেশসমূহের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়। তদুপরি, বিভিন্ন দেশের লেজুরবৃত্তির মাধ্যমে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি গঠন করায় বিশ্বে তারা কোন মর্যাদার আসন লাভ করতে সক্ষম হয় না।

উপরােক্ত বিষয়সমূহ ছাড়াও আরাে অনেক বিষয় এ ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিশেষ বিশেষ উপাদান গুরুত্ব অর্জন করতে পারে। সময়ের পরিবর্তন অথবা রাষ্ট্রীয় অবস্থার পরিবর্তন, অথবা বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রসমূহের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকসমূহ পরিবর্তন হতে পারে। এমন অনেক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, যখন কোন বিশেষ নির্ধারককে অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়ােজনীয় মনে হয়, আবার সেই একই নির্ধারক বিশেষ পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। কখনও কখনও কোন নির্ধারক এককভাবে প্রধান নির্ধারকের ভূমিকা পালন করতে পারে, কখনও আবার কয়েকটি নির্ধারক সমন্বিতভাবে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post