১১. অপারেশন সার্চলাইট ও ২৫ মার্চের গণহত্যাঃ
২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বড় শহরগুলােতে গণহত্যা শুরু করে। তাদের পূর্বপরিকল্পিত এই। গণহত্যাটি "অপারেশন সার্চলাইট" নামে পরিচিত। এ গণহত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগে থেকেই পাকিস্তান আর্মিতে কর্মরত সকল বাঙালি অফিসারদের হত্যা কিংবা গ্রেফতার করার চেষ্টা করা হয়। ঢাকার পিলখানায়, ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ই বি আর সিসহ সারাদেশের সামরিক আধাসামরিক । সৈন্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডের কথা যেন বহির্বিশব না জানতে পারে সে জন্য আগেই সকল বিদেশি সাংবাদিকদের গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ আরােপ করা হয় এবং অনেককে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। তবে ওয়াশিংটন পােস্টের বিখ্যাত সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের রিপাের্ট প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব এই গণহত্যা সম্পর্কে অবগত হয়। আলােচনার নামে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কালক্ষেপণও এই গণহত্যা পরিকল্পনারই অংশ ছিল।
২৫ মার্চ রাত প্রায় সাড়ে এগারােটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পাকিস্তানিদের অপারেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ঢাকা বিশববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং জগন্নাথ হলের ছাত্রদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশববিদ্যালয় ও আশেপাশের বহু সংখ্যক শিক্ষক ও সাধারণ কর্মচারিদেরও হত্যা করা হয়। পুরােনাে ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলােতেও চালানাে হয় ব্যাপক গণহত্যা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে হত্যা করা হয় পুলিশ বাহিনীর বহু সদস্যকে। পিলখানার ইপিআর-এর কেন্দ্রে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় নিরস্ত্র সদস্যদের। কয়েকটি পত্রিকা অফিস ভস্মীভূত করা হয়। দেশময় ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বিচারে হত্যা করা হয় বিভিন্ন এলাকায় ঘুমন্ত নর-নারীকে। হত্যা করা হয় শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদেরও। ধারণা করা হয়, সেই রাত্রিতে একমাত্র ঢাকা ও তার আশে পাশের এলাকাতে প্রায় এক লক্ষ নিরীহ নর-নারীর জীবনাবসান ঘটে।
১২. স্বাধীনতার ঘােষণা
তিনি পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য বাংলার জনগণকে আহবান জানান। চট্টগ্রামে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচারের জন্য পাঠানাে হয়। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু ঘােষণাকে অবলম্বন করে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ হান্নান স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ অপরাহ্নে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার আরেকটি ঘােষণা পাঠ করেন। এই ঘােষণাটিতে তিনি উল্লেখ করেন। যে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। তিনি আরাে উল্লেখ করেন।
যে, নবগঠিত এই রাষ্ট্রের সরকার জোটবদ্ধ না হয়ে বিশেবর অপর রাষ্ট্রগুলাের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টিতে আগ্রহী। এছাড়াও এ ঘােষণায় সারা বিশেবর সরকারগুলােকে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তােলারও আহ্বান জানানাে হয়।
(বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র: মুজিবনগর প্রশাসন, তৃতীয় খন্ড, প্রকাশকাল: নভেম্বর ১৯৮২)
১৩. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনঃ
১০ই এপ্রিল ৭১ নির্বাচিত সাংসদগণ আগরতলায় একত্রিত হয়ে এক সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে সরকার গঠন করেন। এই সরকার স্বাধীন সার্বভৌম "গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার"। স্বাধীনতার সনদ (Charter of Independence) বলে এই সরকারের কার্যকারিতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়। ১৭ই এপ্রিল ৭১ মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামে বৈদ্যনাথ তলায় "গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার" আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির এই সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের শপথ পাঠ করান জাতীয় সংসদের স্পীকার অধ্যাপক ইউসুফ আলী। যে সমস্ত নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় তাঁরা হলেনঃ
এই অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে (বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে) এবং কর্নেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে সরকারী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশ । বিদেশের শতাধিক সাংবাদিক ও হাজার হাজার দেশবাসীর উপস্থিতিতে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাংসদ জনাব আবদুল মান্নান। নবগঠিত সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এই স্থানটির নামকরণ করা হয় "মুজিব নগর"।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিকভাবে এই যুদ্ধকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সর্বসম্মতিক্রমে একটি "সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ" গঠন করেন। এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেনঃ
ক) জনাব আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি ন্যাপ ভাসানী
চ) খন্দকার মােশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদাধিকারবলে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র এই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ, অস্ত্র গােলাবারুদ সরবরাহ, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ সরকার প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতায় উপস্থাপনসহ এবং একটি সময় উপযােগী প্রশাসনিক কাঠামাে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযােগী রাজাকারদের অত্যাচারে প্রায় এক কোটি বাঙালি দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ দেশত্যাগী এই জনগােষ্ঠীর সার্বিক সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে সার্বিকভাবে সহযােগিতা দান করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামােয় কর্মরত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গঃ
১। যে সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রশাসনিক কাঠামােয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনঃ
ক) রাষ্ট্রপতির পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব আবদুস সামাদ আজাদ, এম এন এ
২। বেসামরিক প্রশাসনঃ
ক) ক্যাবিনেট সচিব জনাব হােসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)
৩। কুটনৈতিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযােগ্য করে তুলেছিলেনঃ
ক) মিশন প্রধান যুক্তরাজ্য, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (বহিঃর্বিশ্বে সরকারের বিশেষ দূত)
খ) মিশন প্রধান কলিকাতা, জনাব হােসেন আলী
গ) মিশন প্রধান নতুন দিল্লী, জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।
ঘ) মিশন প্রধান যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জনাব এম আর সিদ্দিকী
ঙ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত ইরাক, জনাব আবু ফতেহ
চ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত সুইজারল্যান্ড, জনাব অলিউর রহমান
ছ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিলিপাইন, জনাব কে কে পন্নী
জ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেপাল, জনাব মােস্তাফিজুর রহমান
ঝ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত হংকং, জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ
ঞ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত জাপান, জনাব এ রহিম।
ট) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত লাগােস, জনাব এম এ জায়গীরদার
৫। মুক্ত এলাকায় সুষ্ঠু প্রশাসনিক কাঠামাে গড়ে তােলা এবং ভারতে অবস্থান গ্রহণকারী শরণার্থীদের দেখাশুনা ও যুব শিবির পরিচালনার জন্য সরকার সমস্ত বাংলাদেশকে ১১টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্রশাসনিক এলাকায় চেয়ারম্যান ও প্রশাসক নিয়ােগ করেন।
১৪, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রঃ
মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের এবং অবরুদ্ধ এলাকার জনগণের মনােবল অক্ষুন্ন রাখার ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের নীতি নির্ধারণী ভাষণসহ জনগণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নির্দেশাবলী প্রচারিত হয়। প্রতিদিনের সংবাদসহ যে সমস্ত অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তার মধ্যে চরমপত্র ও জল্লাদের দরবার অন্যতম। যে সমস্ত ব্যক্তির অক্লান্ত পরিশ্রমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তাঁরা হলেনঃ
১৫. বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীঃ
যে জনযুদ্ধ এনেছে পতাকা, সেই জনযুদ্ধের দাবিদার এদেশের সাত কোটি বাঙালি। একটি সশস্ত্র যুদ্ধ দেশকে শত্রুমুক্ত করে। এই সশস্ত্র যুদ্ধ একটি নির্বাচিত সরকারের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। পরিকল্পিত এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১০ই এপ্রিল '৭১ বাংলাদেশ সরকার সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি যুদ্ধঅঞ্চলে বিভক্ত করেন। এই ৪টি অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত । অধিনায়ক ছিলেনঃ
পরবর্তীতে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে বিভক্ত করে রাজশাহী অঞ্চলে মেজর নাজমুল হক, দিনাজপুর অঞ্চলে মেজর নওয়াজেস উদ্দিন এবং খুলনা অঞ্চলে মেজর জলিলকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ৭ই জুলাই ৭১ যুদ্ধের কৌশলগত কারণে সরকার নিয়মিত পদাতিক ব্রিগেড গঠনের পরিকল্পনায় 'জেড ফোর্স' ব্রিগেড গঠন করেন। এই জেড ফোর্সের অধিনায়ক হলেন লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমান। একই ভাবে সেপ্টেম্বর মাসে 'এস ফোর্স' এবং ১৪ই অক্টোবর 'কে ফোর্স' গঠন করা হয়। কে ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল খালেদ মােশাররফ এবং এস ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল কে. এম. সফিউল্লাহ।
সেক্টর-তিন মেজর কে এম শফিউল্লাহ কুমিল্লা জেলার অংশ, ময়মনসিংহ জেলার অংশ, ঢাকা ও সিলেট জেলার অংশ।এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল সাতটি। সেক্টর ট্রপস্ ছিল ৬৬৯৩ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ২৫,০০০।
১৬. মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরঃ
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে মােট ১৩১ জন অফিসার মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করেন ও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ৫৮ জন তরুণ মুক্তিযােদ্ধা ভারতের মূর্তি অফিসার প্রশিক্ষণ একাডেমী থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করে যুদ্ধে যােগদান করেন। এ কোর্স-কে প্রথম বাংলাদেশ সর্ট সার্ভিস কোর্স বলা হয়। ৬৭ জন তরুণ মুক্তিযােদ্ধাকে দ্বিতীয় সর্ট সার্ভিস কোর্সে ভর্তি করা হয় এবং তারা ১৯৭২ সনে কমিশন প্রাপ্ত হন। মুক্তিযুদ্ধে ১৩ জন সামরিক অফিসার যুদ্ধ অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন। ৪৩ জন সামরিক অফিসারকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ এবং তার কয়েকদিনের মধ্যে হত্যা করে।
0 Comments