মুজিব নগর সরকারের কর্ম তৎপরতা

মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ



Advisory Council of Mujibnagar Government 
মুজিবনগর সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে উপদেশ প্রদান করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদের কাঠামাে নিম্নরূপ :

উপদেষ্টা পরিষদের কাঠামাে।


মাওলানা-আবদুল হামিদ খান ভাসানী   - কমিটির প্রধান  -  ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ভাসানী), চীনপন্থী।
তাজউদ্দিন আহমদ -   আহ্বায়ক -   মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি :
অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ। -   সদস্য।  -  ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ওয়ালী), মস্কোপন্থী
কমরেড মনি সিং   - সদস্য  -  কমিউনিস্ট পার্টি, মস্কোপন্থী
মনােরঞ্জন ধর  -  সদস্য -    পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, ভারতপন্থী। 
খােন্দকার মােশতাক আহমেদ  -  সদস্য   - মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি 
 ক্যাপ্টেন মনসুর আলী  -  সদস্য  -  আওয়ামী লীগ
এ এইচ এম কামরুজ্জামান   - সদস্য -   আওয়ামী লীগ

মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রণালয় বা বিভাগ।
Ministries or Division of Mujibnagar Government
মুজিবনগর সরকারের মােট ১২ টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ছিল। নিচে এ মন্ত্রণালয়গুলাের বিবরণ দেয়া হলাে ঃ
১। প্রতিরক্ষা মন্ত্রাণালয়  প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। প্রধান সেনাপতি ছিলেন কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, সেনা প্রধান ছিলেন লে. কর্নেল আবদুর রব, উপ সেনা প্রধান ও বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার। বাংলাদেশের সমস্ত যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে তিনটি ব্রিগেডও গঠিত হয়। এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই সার্বিক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। 

২। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়  পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মােশতাক আহমদ। বিদেশে মিশন স্থাপন, বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা.এ বিভাগের কাজ ছিল। এ মন্ত্রণালয়ের তৎপরতায় প্রবাসী বাঙালিরা সংঘবদ্ধ হয়। এবং বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গড়ে উঠে। 

৩। অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়  মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটসমূহের অন্যতম হচ্ছে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে সরকার যে সকল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন তার পূর্ণ বিবরণ ঃ 
১. বাজেট প্রণয়ন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ, 
২. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত সম্পদের হিসাব প্রস্তুত, 
৩. বিভিন্ন সংস্থা-ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের দায়িত্ব পালন ও বিধিমালা প্রণয়ন, 
৪. আর্থিক শৃঙ্খলা প্রবর্তন, 
৫. রাজস্ব ও শুল্ক আদায়, 
৬, আর্থিক অনিয়ম:তদন্তের জন্য কমিটি গঠন।

উল্লেখ্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মজিবনগর সরকারের) পূর্ণাঙ্গ বাজেট ছিল। আয়-ব্যয়ের হিসাব সংবলিত এই বাজেটে শুধু সরকারের নয়, বিভিন্ন দফতর, অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, জোনাল অফিস, যুব ক্যাম্প, শরণাথী, বেতার, প্রচারণা ইত্যাদি ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা ছিল।

৪। মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়  অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং তার অধীনে অল্পসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়। এ সচিবালয়ের দায়িত্ব ছিল ?
১. গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি মন্ত্রিপরিষদের নিকটসভায় পেশ করা; 
২. মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ; 
৩. বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ; 
৪. মন্ত্রিপরিষদের সাথ সম্পর্কিত নয় কিন্তু কোনাে মন্ত্রণালয়/বিভাগের আওতাধীনও নয় এমন অন্যান্য বিষয়াদি তদারকি এবং 
৫. আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় সাধন। 
মন্ত্রিপরিষদ সচিব রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের দায়িত্ব পালন করতেন। 

৫। সাধারণ প্রশাসন, সংস্থাপন বিভাগ  সাধারণ প্রশাসন বিভাগে একজন পূর্ণ সচিব নিয়ােজিত ছিলেন। তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কাজ করতেন। এ বিভাগটি সরকারের সংস্থাপন বিষয়ক কাজ যথা - প্রবেশন, নিয়ােগ, বদলি, পােস্টিং, শৃঙ্খলা, সরকারি নিয়ােগের নীতিমালা বাস্তবায়ন, মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর তালিকা সংরক্ষণ, নিয়ােগের জন্য প্যানেল তৈরি, আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিলের অধীন সকল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে লােক নিয়ােগ ইত্যাদি কাজ ছিল সাধারণ প্রশাসনের দায়িত্ব। মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত মােতাবেক সংস্থাপন মন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং) নিজ সরকারের অধীন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সকল পদে নিয়ােগ দান করতেন।
 এছাড়া আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং অন্যান্য বিভাগের (ডিপার্টমেন্টের) কর্মকর্তাদের অফিসসমূহের ব্যবস্থা করা, অফিসসমূহের বাজেট অনুমােদন ইত্যাদি ছিল সাধারণ প্রশাসনের আওতাভুক্ত। 
আঞ্চলিক প্রশাসন সৃষ্টি মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। মূল পরিকল্পনার অধীনে ৫টি অঞ্চল (জোন) সৃষ্টি করা হলেও দেশব্যাপী সুষ্ঠ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলার জন্য জুলাই মাসে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণাকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের আঞ্চলিক প্রশাসক নিয়ােগ করা হয়। শরণার্থী সমস্যা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সামরিক-বেসামরিক বিষয়াবলির সুষ্ঠু সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ ভার এই প্রশাসনিক অঞ্চলগুলাের উপর ন্যস্ত ছিল। এছাড়া ১৮টি জেলায় ১৮ জন জেলা প্রশাসক নিয়ােগ করা হয়েছিল।

 স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিভাগ প্রাথমিকভাবে একজন মহাপরিচালকের অধীনে গঠন করা হয় স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিভাগ। পরে মহাপরিচালককে সরকারের সচিবের মর্যাদা প্রদান করা হয়। এ বিভাগের কার্যাবলি দু’টি পথক ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছিল, যথা ঃ সামরিক বাহিনীর স্বাস্থ্য চিকিৎসা এবং বেসামরিক ক্ষেত্রে চিকিৎসা ও কল্যাণ।

তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়  মুজিবনগর সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ইউনিট ছিল তথ্য ও প্রচার বিভাগ। স্বাধীন বাংলা বেতার সরকারের অধীন সর্বপ্রথম সংস্থাসমূহের অন্যতম। রেডিও স্টেশন স্থাপন করা হয় যার নাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের খবর এবং পাকবাহিনীর হত্যা ও অত্যাচারের কাহিনী প্রচার করার পাশাপাশি পাকবাহিনীকে ধিক্কার ও বিদ্রুপ করে এম, আর, আখতার মুকুল রচিত ও পঠিত 'চরমপত্র' প্রচার করত। এ বেতার অবরুদ্ধ দেশবাসী ও মুক্তিযােদ্ধাদেরকে দারুণভাবে উৎসাহিত করতেন। সরকারের বহির্বিশ্বে সম্প্রচার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপর ন্যস্ত ছিল। এ শাখা পুস্তিকা, ব্রশিউর ইত্যাদি বহু সংখ্যক প্রকাশনা বের করেছে। এগুলাে বৈদেশিক সম্প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। 

৮। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একজন পূর্ণ সচিব নিযুক্ত ছিলেন। তথ্য সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার নিকট সেগুলাে প্রেরণ করা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রধান কাজ। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৪টি রেঞ্জের জন্য ৪ জন ডিআইজি এবং প্রতি জেলার জন্য একজন এসপি নিয়ােগ করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিলসমূহের দায়িত্ব পালন করতেন। এ মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কাজ ছিল নিম্নরূপ : 
১. অবমুক্ত এলাকার প্রশাসনিক কাঠামাে পুনর্গঠন; 
২. ভ্রমণ ডকুমেন্ট ইস্যু করা;
৩. তদন্ত পরিচালনা ইত্যাদি। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান।

 ৯। ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগঃ এটি রিলিফ কমিশনের অধীনে সংগঠিত একটি বিভাগ। সরাসরি স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর অধীনে কাজ করত। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন কামারুজ্জামান। এ বিভাগের উল্লেখযােগ্য দায়িত্বসমূহ হচ্ছে নিম্নরূপঃ 
১. ত্রাণের জন্য গৃহীত বিভিন্ন প্রকার আবেদনপত্র নিখুঁতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশেষ ক্ষেত্রে বাংলাদেশী নাগরিকদেরকে সাহায্য করা; 
২. জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের কাঠামাের মধ্যে জোনাল রিলিফ অফিসসমূহের ব্যবস্থা করা; 
৩. বাংলাদেশ শিক্ষক মণ্ডলীর রিলিফের ব্যবস্থা; 
৪. উদ্বাস্তু শিবিরের শিশুদের উপকারার্থে শিক্ষকদের সেবা কাজে লাগানাের জন্য বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সহযােগিতায় ক্যাম্প-স্কুলসমূহের জন্য একটি স্কিম প্রণয়ন ও আংশিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। 

১০। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী নিজে এটি দেখাশুনা করতেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমস্যাদি সমাধানের দায়িত্ব পালন করত এই বিভাগ। 

১১। কৃষি বিভাগ ঃ এ বিভাগটি পুরােপুরি সংগঠিত ছিল না। কেবল একজন সচিব নিয়ােগ করা হয়েছিল— যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের নকশা ও পরিকল্পনা তৈরি করার দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। 

১২। প্রকৌশল বিভাগ ঃ এ বিভাগে একজন প্রধান প্রকৌশলীর অধীনে জোনাল ইঞ্জিনিয়ারগণ সেক্টর কমান্ডারদেরকে - প্রয়ােজনীয় সহযােগিতার জন্য নিয়ােজিত ছিলেন ,মুক্ত এলাকার প্রকৌশল বিষয়ক সমস্যাদি সমাধানেও তারা দায়িত্ব পালন করতেন।
 মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও কয়েকটি সংস্থা ছিল যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীন কাজ করতেন, যেমন -

(ক) পরিকল্পনা কমিশন ঃ ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে এবং ড. খান সরওয়ার মুর্শেদ, ড. মােশাররফ হােসেন, ড, এস, আর, বােস ও ড. আনিসুজ্জামানকে সদস্য করে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, দেশ ও অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় রেখে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন, দেশের তাৎক্ষণিক পুনর্গঠনের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদানও এর কাজ ছিল ।


(খ) শিল্প ও বাণিজ্য বাের্ড  স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি বাণিজ্য বাের্ড গঠন করা হয়। এই বাের্ড শুধু আয়ের উৎস হিসেবেই নয় বরং বাংলাদেশের আর্থিকভাবে টিকে থাকার জন্য বিদেশে পণ্য রপ্তানির বিভিন্ন উৎস অনুসন্ধান করত।

(গ) যুব ও অভ্যর্থনা শিবিরের নিয়ন্ত্রণ বাের্ড  এ বাের্ডের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম. এন, এ । ব্যাপক আকারে যুব ক্যাম্প ইউনিটগুলাের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। নিয়মিতভাবে যুব ক্যাম্প থেকে ছেলেদেরকে এনে গেরিলা বাহিনীতে ভর্তি করা হয়।

(ঘ) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি  এ কমিটির প্রধান ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কমিটি বাঙালি উদ্বাস্তুদের দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করত।

(ঙ) শরণার্থী কল্যাণ বাের্ড ঃ একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে শরণার্থীদের কল্যাণে শরণার্থী কল্যাণ বাের্ড কার্যকর ছিল।

মুজিবনগরে বিপ্লবী সরকার গঠনের উদ্দেশ্য ।

Objectives of the Formation of Revolutionary Government in Mujibnagar 
একটি নিয়মিত সরকারের লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকে সুচারুরূপে পরিচালনার উদ্দেশ্যে মুজিবনগরে সরকার গঠন করা হয়েছিল। নিচে এর উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যসমূহ বর্ণনা করা হলাে :

১। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণাকে বাস্তবায়িত করা এবং এর আনুষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক রূপ প্রদান করা। 
২। মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠ ও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে দ্রুত দেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করা। 
৩। মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা। 
৪। ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি গড়ে তােলা। 
৫। শরণার্থীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা। 
৬। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করা এবং সাহায্য ও সহযােগিতা লাভের ব্যবস্থা করা। 
৭। মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা।

মুজিবনগর সরকার যথাযথভাবে উপরােক্ত উদ্দেশ্যগুলাের বাস্তবায়ন করেন, যার ফলে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়।

 স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপ্লবী সরকারের ভূমিকা বা অবদান ।

Role or Contribution of Revolutionary Government in Liberation War 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল গৌরবােজ্জ্বল। নিচে এ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে :

১। ছাত্রদের আশান্বিত করে পাক বাহিনী যখন দেশের অভ্যন্তরে ছাত্র যুবকদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছিল তখন মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ায় তারা আশান্বিত হয়ে উঠে। দলে দলে তারা ভারতে এবং বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে চলে যায়।

২। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও প্রশিক্ষণ প্রদান  মুজিবনগর সরকার মুক্তাঞ্চলে এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। এখানে তাদেরকে সামরিক ট্রেনিং দেয়া হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযােদ্ধাদেরকে ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।

৩। যুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব প্রদান  মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দেয়। মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা, মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ঠিক রাখা এবং বিভিন্ন সেক্টর ও গেরিলা বাহিনীর সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব মুজিবনগর সরকার নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিল।

৪। গণমাধ্যম পরিচালনা করা স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনাকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য মুজিবনগর সরকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ও পত্রপিত্রকার মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দেশাত্মবােধক গানগুলাে এবং চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি মুক্তিযােদ্ধা ও জনগণকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল।

৫। বেসামরিক প্রশাসন সৃষ্টি  মুজিবনগর সরকার নানা প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও একটি বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তুলেছিল। বেসামরিক প্রশাসন আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ভূমিকা পালন করে। 

৬। জনমত সৃষ্টি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রয়ােজনীয়তা, লক্ষ্য, পাক বাহিনীর হিংস্রতা ও গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর সাফল্য ইত্যাদি বহির্বিশ্বে প্রচার করে জনমত সৃষ্টিতে মুজিবনগর সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।

৭। সেতুবন্ধন রচনা  স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যভার গ্রহণ করার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক রূপ দেয়ার মানসে ভারত ও রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে যােগাযােগের সেতুবন্ধন রচনা করে।

সবশেষে বলা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধকে গতিময় ও সুসংহত করা, ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী লক্ষ লক্ষ বাঙালি দেখাশুনা এবং বহির্বিশ্বে বাঙালি জাতির ভাবমূর্তিকে তােলে ধরার জন্য মুজিবনগর বিপ্লবী সরকার গঠন করা হয়। এ সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মুক্তিসেনারা তাদের প্রাণশক্তি ফিরে পায় এবং বীর বিক্রমে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

 বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা

Activities of Mujibnagar Government in Outer World 
বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন, কূটনৈতিক তৎপরতা, প্রতিনিধি প্রেরণ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন লাভের চেষ্টা, বিদেশে তহবিল সংগ্রহ ইত্যাদি ছিল বহির্বিশ্বে তৎপরতার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এসব তৎপরতার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি এবং নিউইয়র্ক ও লন্ডন দূতাবাসের প্রধান। তাছাড়া বহির্বিশ্বে তিনিই ছিলেন মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত। মুজিবনগর সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এপ্রিল মাস থেকে পাকিস্তান দূতাবাসের অনেক বাঙালি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ। করেন। এভাবে মুক্তিযুদ্ধকালে প্রায় ৩৮ জন উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তা পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং বাংলাদেশ মিশনে যােগদান বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের গ্রহণযােগ্যতা বাড়িয়ে দেয়।

 জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যােগদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মুজিবনগর সরকারের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। ১৬ অক্টোবর হতে ২০ অক্টোবর তারা ওয়াশিংটন সিনেটর কেনেডি, পার্সী ও কংগ্রেসম্যান গালাকারসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৪৭টি দেশের প্রতিনিধি বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলােচনা করেন। তবে এসব বক্তব্যে গণহত্যা বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার তেমন কোনাে মুখ্য বিষয় বলে বিবেচিত হয় নি বরং রাজনৈতিক সমাধানের আবেদনই ছিল মুখ্য। তাসত্তেও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি সহৃদয়তার সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরী ও তার সহকর্মীদের বক্তব্য শােনেন এবং তাদের সরকারকে তা জানাবেন বলে আশ্বাস দেন।

বহির্বিশ্বে মজিবনগর সরকারের এ ধরনের তৎপরতার ফলে বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকবাহিনীর ধর্ষণ নির্যাতন ও গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির প্রতি বিশ্বব্যাপী যে সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতারই ফল।


স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র
Proclamation of Independence 

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ইংরেজিতে প্রণীত 'Proclamation of Independence' ঘােষিত ও জারি করা হয়। আর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার  বৈদ্যনাথ তলায় স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ১৯৭২সালের ২৩ মে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়।

স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র নিচে উল্লেখ করা হলাে :

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র আদেশ

১০ই এপ্রিল ১৯৭১

মুজিব নগর
১৭ই এপ্রিল, ১৯৭১ 

“যেহেতু ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর হতে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হইয়াছিল।
এবং .
 যেহেতু এ নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচন করেছিলেন,
এবং

যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন,


এবং 
যেহেতু আহূত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করেন, 
এবং

যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করবার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সাথে পারস্পরিক আলােচনাকালে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ন্যায়নীতি বহির্ভূত ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘােষণা করেন,
এবং .

যেহেতু, উল্লিখিত বিশ্বাসঘাকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভুত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান,

এবং ' 
 যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনাে বাংলাদেশে বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজীরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে।

এবং
যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করে তুলেছে।

যেহেতু, বাংলাদেশের বীর সন্তানগণ তাদের সাহস, বীরত্ব ও বিপ্লবী চেতনার মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে, আমরা যারা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশের জনগণ আমাদের উপর যে গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করেছে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলনে আমরা একটি গণপরিষদ গঠন করলাম এবং আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সাম্য, মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তার জন্য বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘােষিত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঘােষণা করছি এবং যে পর্যন্ত না একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয় সে পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং রাষ্ট্রপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক থাকবেন এবং তিনি রাষ্ট্রে সমুদয় নির্বাহী ও রাষ্ট্রীয় অন্যান্য ক্ষমতাসহ ক্ষমা প্রদানের ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারবেন,  
তিনি প্রধানমন্ত্রী ও প্রয়ােজনে অন্যান্য মন্ত্রিকেও নিয়ােগ করতে পারবেন। তিনি কর ধার্য ও রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করতে পারবেন, তিনি গণপরিষদ আহ্বান ও মূলতবি ঘােষণা করতে পারবেন,

বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি সুন্দর ও সুষ্ঠ সরকার গঠনের প্রয়ােজনে তিনি যে কোন কাজ করতে পারবেন,

আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আরাে ঘােষণা করছি যে, রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে তথা রাষ্ট্রপতি যখন তার দায়িত্ব  গ্রহণে অপারগ অথবা দায়িত্ব পালনে সক্ষম নন, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সকল দায়-দায়িত্ব উপরাষ্ট্রপতি পালন করবেন।

আমরা আরাে ঘােষণা করছি যে, জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আমাদের যে দায় দায়িত্ব তা পালন করব,

আমরা আরাে ঘােষণা করছি যে, স্বাধীনতার এই ঘােষণা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে মার্চ থেকে কার্যকর হবে। আমরা আরাে সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপরাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করলাম।”

                                                                                                                                        স্বাক্ষর
প্রফেসর এম. ইউসুফ আলী
(এম.এন.এ)



স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের গুরুত্ব
Importance of Proclamation of Independence 
বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে স্বাধীনতার সনদ বা ঘােষণাপত্রের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম । যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মৌলিক আইনের ভিত্তি ছিল এই স্বাধীনতার সনদ। এর মাধ্যমে মুজিবনগর প্রশাসনের সকল কর্মকাণ্ডের বৈধকরণ করা হয়। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ লিখেছেন, “এই সনদ ছিল আইনের মূল সূতিকাগার এবং সরকারের সমস্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার উৎস। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এটিই ছিল দেশের সংবিধান।”

মওদুদ আহমদ আরও মন্তব্য করেছেন, “এছাড়া জনগণকে সুশৃঙ্খল ন্যায় নির্ধারক একটি সরকার উপহার দেয়ার লক্ষ্যে ক্ষমা ঘােষণা, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ নিয়ােগ, কর ও খাজনা আরােপ, সাংবিধানিক সংসদ আবান ও স্থগিতকরণ এবং ইত্যাকার নানাবিধ ক্ষমতাসহ রাষ্ট্রপতিকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবেও নিয়ােগ করা হয় ।”

এই সনদটি পর্যালােচনা করলে উপলব্ধি করা যায় যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামনে রেখে তার নামে সংগ্রাম পরিচালনার উদ্দেশ্যেই এটি রচনা করা হয়। বিদ্যমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এই সনদ প্রেসিডেন্টের উপর রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করে।

এই সনদের মাধ্যমে সরকারের সিভিল প্রশাসন ও সামরিক প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড নিশ্চিত করা হয়, মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতাকে সুনিয়ন্ত্রিত করে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালনা করা এবং তাকে একটি আইনগত ভিত্তি দেয়ার জন্য এটি প্রয়ােজন ছিল। 

এই সনদটি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে সনদে উল্লেখ করা হয়। এই সনদে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র অনুমােদন দেয়া হয়। এই সনদটি যে জাতিসংঘ ঘােষিত আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আদায় সংক্রান্ত সনদের আলােকে বৈধ ছিল তাও যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। সনদে যুক্তি উপস্থাপন করে উল্লেখ করা হয় যে, আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র এলাকা এবং সম্মিলিত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে শাসন করার আইনগত অধিকার অর্জন করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে প্রদেশ প্রতিশ্রুতি আদায় থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারা নিজেদের একত্রিত করার একটি আইনগত অধিকার অর্জন করেছেন। এই অধিকার বলেই ঘোষিত স্বাধীনতার সনদ বৈধতা পেয়েছে। সনদে জাতিসংঘের সকল দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় এবং এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রত্যাশা করা হয়।

মওদুদ আহম্মদ লিখেছেন : “১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর দেশ পরিচালনার জন্য আইনসমূহের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে এই সনদ অব্যাহতভাবে কার্যকর থাকে এবং এর অধীনে প্রণীত সকল আইনের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল অবিসংবাদিত। এভাবে এই সনদটি একটি বাস্তবতায় পরিণত হয়; এর মাধ্যমেই পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় সূচিত হয়।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে সনদে উল্লেখ করা হয়। এটিকে | বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক ঘােষণা’ হিসেবে চিহ্নত করা হয়। ঘােষণায় বলা হয়

“সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে যে রায় দিয়েছেন, সে মােতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা অনুমােদন করছি।..... আমাদের স্বাধীনতার এ ঘােষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে।”


 আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ
Execution Order of Succession of Law 
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের পাশাপাশি সর্বক্ষেত্রে আইনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার সনদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রেসিডেন্ট আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ জারি করেন। এটি ২৬ মার্চ থেকে  কার্যকর বলে ঘােষণা করা হয়। ছিল পাকিস্তান আমল থেকে চলমান সকল আইন (প্রয়ােজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন সাপেক্ষে) বৈধকরণ ও কার্যকর করা ছিল। এই আদেশের উদ্দেশ্য তবে বাংলাদেশের জন্য যে সকল আইন সামঞ্জস্যহীন বলে - মনে হবে তা কার্যকর করা যাবে না। এই আদেশের মাধ্যমে চাকরিজীবীগণকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয় যে, সরকারি, বেসামরিক, সামরিক, বিচার বিভাগীয় এবং কূটনৈতিক যে সমস্ত অফিসার বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘােষণা করেন, তারা তাদের - চাকরির প্রচলিত শর্ত অনুযায়ী পদমর্যাদা এবং প্রাপ্ত সকল সুযােগ-সুবিধা অব্যাহত রাখার অধিকার পারেন। এভাবে এই আইন চাকরিজীবীগণের চাকরির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে এবং পাকিস্তান আমলে তারা যে সকল সুযােগ-সুবিধা ভােগ করছিলেন তা অব্যাহত রাখার-আইনগত বৈধতা লাভ করেন।

 নিচে আইনের ধারাবাহিকতা বলবঙ্করণ আদেশটি উল্লেখ করা হলাে -


আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণের আদেশ।

 ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১ 
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে ক্ষমতাবলে আইনের ধারাবাহিকতা বলবকরণ আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারি করেন। স্বাধীনতা ঘােষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে সকল আইন চালু ছিল, তা রক্ষার্থে এই আদেশ জারি করা হয়। অবশ্য ১৭ এপ্রিল থেকেই মূলত এই আদেশ কার্যকরী ও বলবৎ হয়। নিচে আইনের ধারাবাহিকতা বলবকরণের আদেশ তুলে ধরা হলাে :

: “আমি বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বাধীনতা ঘােষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১০ই এপ্রিল তারিখে আদেশ জারি করছি যে, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে সমস্ত আইন চালু ছিল, তা ঘােষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে চালু থাকবে, তবে প্রয়ােজনীয় সংশােধনী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের জন্য করা যাবে, এই রাষ্ট্র গঠন বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছায় হয়েছে। এক্ষণে সকল সরকারি সামরিক বেসামরিক বিচার বিভাগীয় এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছেন, তারা এতদিন পর্যন্ত নিয়ােগ বিধির আওতায় যে শর্তে তারা চাকরিতে বহাল ছিলেন সেই শর্তে তারা চাকরিতে বহাল থাকবেন। বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত সকল জেলা জজ এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সকল কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা যারা অন্যত্র অবস্থান করছেন, তারা সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের স্ব স্ব এলাকায় আনুগত্যের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন। 
এই আদেশ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে।”

 স্বাক্ষর 
সৈয়দ নজরুল ইসলাম 
 (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি)


Post a Comment

Previous Post Next Post