১৯৩০ সালের ৮ অগাস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ফজিলাতুন নেছা রেনু। তিন বছর বয়সে তিনি বাবা জহুরুল হক এবং পাঁচ বছর বয়সে মা হোসনে আরা বেগমকে হারান। দাদা শেখ আবুল কাশেম শৈশবেই রেনুর সঙ্গে তার চাচাতো ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে দেন। শেখ মুজিবের মা সায়েরা খাতুনের স্নেহ, মায়া-মমতায় বড় হন রেনু।
ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ছিল তার অদম্য আগ্রহ। প্রবল স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। যে কারণে বঙ্গবন্ধু তাকে জীবন্ত ডায়েরির’ সঙ্গে তুলনা করতেন।
সেই বালিকাবধূর স্বামী শেখ মুজিব কোনো সাধারণ বাঙালি ছিলেন না। কৈশোরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর তার বাকি জীবন কেটেছে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে এবং স্বাধীনতার পর দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব দিয়ে। জীবনের বড় একটি অংশ তাকে কাটাতে হয়েছে কারাগারে।
বঙ্গবন্ধুর সেই সংগ্রামী জীবনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা ছিলেন ছায়াসঙ্গী। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে, তার অবর্তমানে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনা করাসহ প্রতিটি কাজে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, যার বিবরণ বিভিন্ন সময়ে তাদের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা উঠে এসেছে।
বঙ্গমাতা’ স্মারক গ্রন্থে তার জীবনীতে বলা হয়েছে, মানবকল্যাণে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার ছিল অপরিসীম অবদান। তিনি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও গরিব আত্মীয়স্বজনের রোগশোকে চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক সংকটে মুক্তহস্তে দান করতেন। এ ছাড়া কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে আর্থিক সাহায্য, অনাথ, এতিম ও গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সব সময়ই।
বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে কারাবাস ও রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনি নিজেই ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, পরিবার-পরিজনদের খোঁজখবর নেওয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ পুরো দায়ভার বহন করতেন। এককথায় দলীয় কর্মীসহ আত্মীয়স্বজনের সব সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন তিনি। খুব অল্প বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম হয় ফজিলাতুন নেছার। কিন্তু জন্মের সময় সেই সন্তান মারা গেলে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ততায় বঙ্গবন্ধু তখন তার পাশে থাকতে পারেননি। পরে ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম হয় তাদের মেয়ে শেখ হাসিনার। তখনও বঙ্গবন্ধু কলকাতায় দাঙ্গাবিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচি ফেলে স্ত্রীর কাছে আসতে পারেননি।
ফজিলাতুন নেছা অনুধাবন করেছিলেন, স্বামীর দেশসেবার কাজ তার সান্নিধ্যের চেয়ে অনেক বড়। দেশের স্বার্থের কাছে নিজের স্বার্থ স্থান পায়নি তার কাছে।
১৯৪৯ সালে শেখ কামাল ও ১৯৫৩ সালে শেখ জামালের জন্ম হয় টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তখন তিন সন্তানের জননী ফজিলাতুন নেছা টুঙ্গিপাড়া থেকে গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী লেনের ভাড়া বাসায় ওঠেন।
শেখ মুজিব ওই বছরই ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় বন ও কৃষি দপ্তরের দায়িত্ব পেলে ৩ নম্বর মিন্টো রোডের বাড়িতে উঠে আসেন ফজিলাতুন নেছা। কিন্তু ঘর সাজানোর আগেই মন্ত্রিসভা ভেঙে যায়, গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। পুলিশি হয়রানির শিকার ফজিলাতুন নেছাকে ১৪ দিনের নোটিসে আবার বাসা খুঁজতে হয়। ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হলে কিছুদিন ছেলেমেয়েদের নিয়ে টি বোর্ডের বাড়িতে ছিলেন ফজিলাতুন নেছা। ১৯৫৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্ম হয় তাদের দ্বিতীয় মেয়ে শেখ রেহানার। পরের বছর আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির প্রতিবাদ করায় জেলে যেতে হয় শেখ মুজিবকে। ফজিলাতুন নেছাকেও তখন টি বোর্ডের বাড়ি ছাড়তে হয়।
১৯৬১ সালে ছাড়া পেয়ে আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নেন শেখ মুজিব। ওই বছরই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটির কাজ শুরু করেন ফজিলাতুন নেছা। ১ অক্টোবর তারা সেই বাড়িতে ওঠেন। সেখানেই জন্ম হয় শেখ রাসেলের।
একসময় সেই বাড়িই হয়ে ওঠে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের শক্তিকেন্দ্র। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। আর প্রতিটি দুর্বিপাকে ফজিলাতুন নেছা পরিস্থিতি সামলে গেছেন সাহসের সঙ্গে।
১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জেলখানায় থাকা অবস্থায় তার প্রথম মেয়ে শেখ হাসিনার বিয়ের কাজ নিজেই সমাধা করেন ফজিলাতুন নেছা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় প্রবাসী বাঙালিদের সহযোগিতায় লন্ডন থেকে আইনজীবী আনার ব্যবস্থা করেন।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে, সত্তরের নির্বাচনের সময় জনমত গঠনে যেমন ফজিলাতুন নেছার ভূমিকা ছিল, তেমনি একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যেও ছিল ফজিলাতুন নেছার উৎসাহ ও প্রেরণা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলে সন্তানদের নিয়ে বারবার স্থান পরিবর্তন করতে হয় ফজিলাতুন নেছাকে। কিন্তু তাতেও তিনি নিস্তার পাননি। হানাদার বাহিনী তাকে মগবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে বন্দি করে রাখে।
ওই সময় ২৭ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ মিয়ার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকেরা সেদিন ফজিলাতুন নেছাকে হাসপাতালে তার মেয়ের পাশে থাকতে দেয়নি।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন। পরদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর অশোক এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ধানমণ্ডির ওই বাড়ি ঘেরাও করে। সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করলে সন্তানদের নিয়ে মুক্ত হন ফজিলাতুন নেছা ও পরিবারের সদস্যরা।
যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরেন তার দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামাল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডনে হয়ে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমে তিনি সরাসরি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে লক্ষ জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন। তারপর মিলিত হন পরিবারের সঙ্গে।
এরপর শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের পর্ব। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সঙ্গে সেই কাজেও সহযাত্রী ছিলেন ফজিলাতুন নেছা। বিশেষ করে নির্যাতিত মা-বোনদের চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ তিনি নেন।
কিন্তু স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
তার পরিবারের ছয় বছরের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও সেদিন ঘাতকের গুলি থেকে রেহাই পায়নি। বিদেশে থাকায় সেদিন প্রাণে বেঁচে যান কেবল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
সেই রাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ৩২ নম্বরের বাড়ির দোতল থেকে ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে নিচে নেমে আসতে বলে খুনিরা। কিন্তু সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। চিৎকার করে বলেন, আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।
পরে ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে তার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই গুলি করে তাকে হত্যা করে খুনিরা।
বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন পুরুষ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুদীর্ঘ পর্যায়ে যে মহীয়সী নারী , প্রেরণাদায়ী হিসেবে সর্বদায় ছায়ার মতো বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সহযোগিতায় ছিলেন তিনিই বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব । চেতনায় বাঙালিত্বকে ধারণ করে , বঙ্গবন্ধুকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছেন । বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি রয়েছে তার অনন্য অবদান । তিনি সাধারণ নারী নন, বরং বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘজীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে শক্ত হাতে হাল ধরেছেন নিজ পরিবারের , সেইসাথে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী মুক্তিকামী বাংলার আপামর জনসাধারণের পাশে ছিলেন অতন্দ্র প্রহরীর মত , তার মাতৃস্নেহ হয়ে উঠেছিল বাঙালির আশ্রয়স্থল।
শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যে নারীর, তিনি তার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও তিনি জীবনভর বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সংসারের দায়িত্ব তিনি একাই সামনে নিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু নিশ্চিন্তে মন দিয়েছেন দেশের কাজে ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ অসমাপ্ত আত্মজীবনী তে লেখা ,সংসার, রাজনীতি এবং কর্মজীবনের বর্ণনায় বারবার স্ত্রী বেগম মুজিবের নাম উচ্চারণ করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিণীর নাম নয়, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম এক নেপথ্য অনুপ্রেরণা দাত্রী। তার ট্যাগ ও সংগ্রামের কথা খুঁজে পাওয়া যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব ইতিহাসেও - তাইতো তিনি শুধু রেণু থেকে বঙ্গমাতা এ পরিণত অনুকরণ ও অনুসরণ ইতিহাসের এক আদর্শ নারী।বঙ্গমাতা ছিলেন মনেপ্রাণে একজন আদর্শ নারী ,বিচক্ষণ উপদেষ্টা ও পরামর্শকারী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস।
দেশের অনেক, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেতারা বেগম মুজিবের কাছে আসতেন দেখা করতে, পরামর্শ নিতে, নির্দেশনা জানতে। আইয়ুব খান ভুট্টোকে মন্ত্রিত্ব থেকে বের করে দিলে সে-ও ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসায় ছুটে আসে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা এলে পর্দার আড়াল থেকে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন বেগম মুজিব। কখনোই সামনে আসতেন না। ছেলে-মেয়েদের বলতেন, ‘ওদের সাথে তো আর আমরা থাকব না, কেন দেখা করব? ওদের চেহারাও আমার দেখতে ইচ্ছা করে না।’ বঙ্গবন্ধু এমএলএ, এমপি-মন্ত্রী থাকাকালে অনেকবার করাচি গেছেন। বেগম মুজিব একবারের জন্যও তাঁর সঙ্গী হন নাই। কখনো যেতে চাইতেন না। সবার আগে তিনিই বুঝেছিলেন এ দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। তাঁর মধ্যে এই চেতনা অত্যন্ত তীব্র ছিল এবং বিশ্বাসও ছিল।
শক্তিমান রাজনীতিবিদ ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমান এক বক্তিতায় বঙ্গভবনে বলেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবা, জহরলাল নেহেরুর স্ত্রী কমলা, এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর সাথে তুলনা করতে গিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কে বঙ্গমাতা অভিধায় ভূষিত করেন।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তান সরকার ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে। ৭ জুন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে ধর্মঘট সফলভাবে পালনে বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল অন্যতম। গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি লুকিয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তাঁদের ছোট ফুফুর ফ্ল্যাট বাসায় চলে যেতেন। ওখানে গিয়ে নিজের স্যান্ডেল বদলাতেন, কাপড় বদলে, বোরকা পরে একটা স্কুটার ভাড়া করে ঢাকায় পড়ুয়া ছোট ভাইকে নিয়ে ছাত্রনেতা আর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। আন্দোলন চালাবে কিভাবে তার পরামর্শ, নির্দেশনা তিনি নিজেই দিতেন। আবার ওই বাসায় ফিরে এসে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নিজের বাসায় ফিরতেন। বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে এই ধর্মঘট যাতে পালিত হয় এবং চলমান আন্দোলনের সফলতার জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যেতেন। সবই করতেন গোপনে এবং রাজনৈতিক মেধায়।
আগরতলা মামলা নিষ্পত্তির জন্য আইয়ুব খান লাহোরে গোলটেবিল বৈঠক ডাকে। প্রস্তাব দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে ছাড়া হবে প্যারোলে। বেগম মুজিব স্বামীর কাছে খবর পাঠালেন যেন তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত না নেন। জানালেন দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে। মামলা তুলে বঙ্গবন্ধুসহ বন্দি ৩৫ জনের সবাইকে মুক্তি দিলেই গোলটেবিল বৈঠক হতে পারে, অন্যথা একা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যে দূরদর্শিতা তিনি সেদিন দেখিয়ে ছিলেন তা পরবর্তী সময়ে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের পথের নির্দেশনা দিয়েছিল।
দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ কৃত নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিজস্ব পারিবারিক জীবন নাই বললেই চলে । তাদের সাথে সহযোগিতা ও সংসার করা খুবই কঠিন এবং দুরহ ব্যাপার , কিন্তু ব্যতিক্রমী ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ।
ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে বারবার জেলে যেতে হয়েছিল , সেই কারারুদ্ধ দিনগুলোতে রেনু যোগ্য সহধর্মিণীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন । ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে শেখ মুজিবের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন । বেগম ফজিলাতুন্নেছা গুরুত্বপূর্ণতথ্য বৃদ্ধিতে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বেগবান হয় । আন্দোলন ও গণবিরোধী গণবিক্ষোভের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হলেন ২২ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ পরের দিন ২৩ শে ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা তাদের অবিসংবাদিত নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয় ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহসিকতা দৃঢ় মনোবল নিয়ে রেনু পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিলেন । হাজার ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ২৩ মার্চ এর পতাকা উত্তোলন বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন এই বঙ্গমাতা রেনু । নেপথ্যে থেকে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে এবং ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। বন্দি থেকেও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ এড়িয়ে দলের নেতাদের নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন। বেশ কয়েকবার গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ ও শাস্তি-নির্যাতনের হুমকি দেয়, তবু তিনি ছিলেন অকুতোভয়। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে ও বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ান তিনি ।
শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যে মহীয়সী নারীর তিনি তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব । আজ আমাদের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তিনি সারাটা জীবন ভর বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে ছিলেন। সংসারের সকল দায়িত্ব তিনি একাই সামনে দিয়েছেন শেখ মুজিব নিশ্চিন্তে মন দিয়েছে দেশ গড়ার কাজে রাজনীতিতে জনসেবায় । এই মহীয়সী নারী ছিলেন বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতির পিতার একজন যোগ্য বিশ্বস্ত সহচর । দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই স্বপ্ন দেখতেন তাইতো তিনি শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেনু নন আমাদের বঙ্গমাতা।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২এর রাতে একাকিত্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তিনি বলেছিলেন , তুমি ফিরে এসেছো সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ, আমি উল্লসিত কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত ধূসর প্রান্তরে, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্ত পুরুষ এবং সন্তানহারা জনক-জননী তোমার প্রতীক্ষায় । শত কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছেন ভাসানীসহ দেশ-বিদেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের যা সম্পূর্ণ ইতিহাস, আদর্শ বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি ।
এমনও দিন গেছে মামলা চালাতে গিয়ে তাঁর কাগজপত্র, উকিল জোগাড় করতে অনেক খরচ হয়ে গেছে। এদিকে বাজারও করতে পারেননি। কোনো দিন বলেননি যে টাকা নাই, বাজার করতে পারলাম না। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছেন। আচার দিয়ে ছেলে-মেয়েদের বলেছেন যে প্রতিদিন ভাত-মাছ খেতে ভালো লাগে নাকি। আসো, আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাই, এটা খেতে খুব মজা। একজন মানুষ, তাঁর চরিত্র কতটা সুদৃঢ় থাকলে যেকোনো অবস্থা মোকাবেলা করার মতো ক্ষমতা ধারণ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পদে পদে তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। প্রকাশ্যে প্রচারে কখনোই আসেননি।
বঙ্গমাতা কতোটা দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ছিলেন সেটি বোঝা যায় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যে। ওই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আম্মার যে মনোবল দেখেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। স্বামীকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দি। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন কিন্তু আম্মা মনোবল হারাননি।
কোটি বাঙালির স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হোক বঙ্গমাতা , প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় ধ্রুব তারার মতন জ্বলজ্বলে বঙ্গজননীর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান । যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বঙ্গমাতা থাকবেন আমাদের অস্তিত্বে ।
জাতির পিতাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে এগিয়ে নেওয়া এই মহিয়সী জননীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
0 Comments