১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং বিএনপি'র পতন বা পরাজয়ের কারণ।



১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং বিএনপি'র পতন বা পরাজয়ের কারণ।
Causes of the Victory of the Awami Leage and Fall or Those of the Defeat of BNP

১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং বিএনপি’র পরাজয়ের কারণগুলাে ছিল নিম্নরূপঃ

১। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি  পূর্বের নির্বাচনগুলােতে প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই প্রচুর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও ক্ষমতায় গিয়ে তারা তা বাস্তবায়ন করে নি। বিশেষ করে বিএনপি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে রেডিও ও টেলিভিশনকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ নানা রকম সুযােগ সুবিধা প্রদানের কথা বললে ক্ষমতায় গিয়ে এর উল্টোটাই করেছিল। আওয়ামী লীগ এরই সুযােগ গ্রহণ করেছিল। কারণ ১৯৭৫ সালের পর তারা ক্ষমতায় যেতে পারে নি এবং নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করার সুযােগও পায় নি।
২। আওয়ামী লীগ ঠেকাও কৌশল প্রতিহতকরণ ঃ ১৯৭৫ সালের পর যতবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, ততবারই সব রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে আওয়ামী লীগ ঠেকাও' নীতি বা কৌশল অবলম্বন করে সফল হয়েছিল। কিন্তু এবারের . নির্বাচনের পূর্বে বিএনপি অন্য সকল রাজনৈতিক দলকে পূর্বের কৌশল প্রয়ােগ করে পুরােপুরি একত্রিত করতে পারে নি। 

৩। বিএনপি ঠেকাও কৌশল অবলম্বন  দলীয় প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগই ছিল নেতৃত্বের ভূমিকায়। আওয়ামী লীগ এ আন্দোলনে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের সক্রিয় এবং নীরব সমর্থন লাভ করে।

 ৪। সংগ্রামী নেত্রীর ভাবমূর্তি  ১৯৯০-এর গণআন্দোলনের অর্থাৎ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন বিরােধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হন। খালেদা জিয়ার শাসন আমলে বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিগত আড়াই বছরের আন্দোলনের সময় একক নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা তার সংগ্রামী নেত্রীর ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হন। বিশেষ করে শহরে এবং শিল্পাঞ্চলে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতদের মধ্যে তার সংগ্রামী নেত্রীসুলভ ভাবমূর্তি '৯৬-এর : নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।

৫। ত্রিমুখী ও চতুর্মুখী নির্বাচনী যুদ্ধ ঃ ১৯৯১-এর নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ ঠেকাও’ কৌশল অবলম্বন করে অন্য দলগুলাের বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামের সাথে গােপন আঁতাত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগও তেমনি বিএনপি ঠেকাও’ কৌশল অবলম্বন করে অন্যান্য সকল দলকে বিএনপি বিরােধী প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে এ নির্বাচনে সামান্য কিছু আসনে আওয়ামী লীগ বিরােধী গােপন আঁতাত গড়ে উঠলেও তা সর্বজনীন কৌশলে পরিণত হতে পারে নি। এর ফলে আওয়ামী লীগ বিরােধী ভােট কয়েকটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ এতে লাভবান হয়। .

৬। অতীতের ভুলত্রুটি মার্জনার আবেদন এ নির্বাচনের পূর্বে সর্বপ্রথম আওয়ামী লীগ নেতা ও ঢাকার মেয়র মােঃ হানিফ বলেন যে, অতীতে আমরা যেসব ভুলত্রুটি করেছি তা আপনারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।' আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও বলেন ‘অতীতের ভুলত্রুটি দেশবাসী ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। অতীতের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করার এ বিনীত আবেদন জনগণের মনে আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি করে। বিএনপি নেত্রীবৃন্দ একবারও বলেন নি যে ,তারা কোন ভূলত্রুটি করেছেন। ফলে অধিকাংশ জনগণ বিএনপি-এর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। .

৭। প্রশাসনে দলীয়করণ ইস্যু বিরােধী দলগুলাে দাবি করে যে, বেগম খালেদা জিয়ার শাসন আমলে প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয়করন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ প্রশাসনে দলীয়করণের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করে তুলতে সক্ষম হন। এছাড়া ও আওয়ামী লীগ দঢ় কণ্ঠে ঘােষণা করে যে তারা ক্ষমতায় গেলে প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হবে না। এর ফলে আধকাংশ জনগণ নির্বাচনে বিএনপি-এর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং আওয়ামী লীগকে সমর্থন দান করে।

৮। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঃ বেগম খালেদা জিয়ার শাসন আমলে বিএনপি নেতা কর্মীগণ ব্যাপকভাবে দুর্নীতিতে লিপ্ত রয়েছেন বলে বিএনপি-বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে অভিযােগ উত্থাপন করে। নির্বাচনী সমাবেশগুলােতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেত্রীবৃন্দ কর্তক বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারবর্গ, মন্ত্রিসভার কিছু কিছু সদস্য এবং বিএনপি-এর অনেক নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযােগ বিএনপি-এর জনপ্রিয়তা হ্রাস করে। ফলে '৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তা সমর্থন বৃদ্ধি পায়। .

৯। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজী  বিএনপি’র শাসন আমলে এরশাদ শাসন আমলে মতই সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজী চলতে থাকে। সন্ত্রাসী ও চাদাবাজ মাস্তানদের হাতে ব্যবসায়ী শ্রেণী নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হতে থাকেন। ফলে এ দেশের মানুষ বিএনপি'র প্রতি বিরূপ হয়ে উঠে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তােলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলে তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন বৃদ্ধি পায়।


১০। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনমূলক নির্বাচন বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি প্রত্যাখ্যান করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। বিএনপি ছাড়া সকল দল এ নির্বাচন বয়কট করে। ভােটারবিহীন এ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।


১১। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু  বিএনপি’র শাসন আমলে ঢাকার মেয়র নির্বাচনে বিএনপি’র সহিংস আচরণ ঢাকাবাসী তথা দেশবাসা সুনজরে দেখে নি। পরবর্তী সময়ে বিএনপি'র শাসন আমলে মীরপুরের নির্বাচন এবং মাগুরার উপ- নির্বাচন বিএনপির রাজনৈতিক সততা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হয়। মাগুরার উপনির্বাচনের পর আওয়ামীলীগ ও অন্যান্য বিরােধী দলগুলাে ঘােষণা করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি সরকারের অধীনে তারা কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এর পর সারা দেশে বিএনপি বিরােধী যে আন্দোলন গড়ে উঠে তার মূল লক্ষ্যই ছিল তত্তাবধায়ক সরকারের দাবি। এ দাবি ধীরে ধীরে জনগণের দাবিতে পরিণত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় করে তােলে।

১২। কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান  বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার কৃষি, সার, পানি, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের উপর থকে ভর্তুকি তুলে নেয়ার ফলে কৃষকরা বিপর্যস্ত হয়েছিল। সারের দাবিতে এ দেশের কৃষককে প্রাণ দিতে হয়েছিল। অপরদিকে শেখ হাসিনা কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানের অঙ্গীকার প্রদান করেন। এর ফলে কৃষক সমাজের নিকটও তিনি সমাদৃত হন। '৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কৃষকদের সমর্থন লাভ করে বিজয় লাভ করতে সমর্থ হয়।

১৩। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা  বেগম খালেদা জিয়ার আমলে অগণতান্ত্রিক ও নিপীড়নমূলক বিজ্ঞাপন বণ্টননীতি স্বাধীন নিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংবাদপত্রগুলােকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করে। নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ ঘােষণা করে যে, তারা নির্বাচিত হলে এ নিপীড়নমূলক বিজ্ঞাপন নীতি বাতিল করা হবে এবং সংবাদপত্রগুলােকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হবে। এ ঘােষণা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

১৪। রেডিও টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন  রেডিও টেলিভিশন জনমত গঠনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এরশাদ শাসন আমল ও বিএনপি সরকারের শাসন আমলে এ দু’টি মাধ্যমকে সরকারের প্রচার মাধ্যম হিসেবে পরিণত করা হয়। এ দু'টি প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা বলে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ ঘােষণা করে যে, তারা ক্ষমতায় গেলে রেডিও ও টেলিভিশনকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে। সবিনয়ে জানতে চাই’ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা রেডিও ও টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন প্রদানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। তার এ প্রতিশ্রুতি দেশের মানুষের নিকট সমাদত হয়। এর ফলে '৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি সচেতন মানুষের সমর্থন লাভ করেন এবং বিজয় লাভ করেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post