পাকিস্তান জাতি গঠনের সমস্যা:
১৯৪৭ হতে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে যেসব কারণে রাজনৈতিক সংহতি অর্জিত হয় নি, তা নিচে আলােচনা করা হলােঃ
১। একাত্মতার সংকট (The Indentity Crisis)ঃ ১৯৭১ সালের পূর্বে তৎকালীন পাকিস্তানে জাতীয় সংহতির সমস্যা ছিল সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা এবং এ সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলেই শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একাত্মতার সংকট মীমাংসা করার দু'টি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হচ্ছে "Blood and Iron Policy" অর্থাৎ বলপূর্বক ঐক্য আনয়ন করা, আঞ্চলিক চেতনা ও আনুগত্যের জোরপূর্বক অবমাননা করা। আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির উচ্ছেদ করে একটি জাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তােলা। আর দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে পারস্পরিক সহযােগিতা, সহানুভূতি ও সমঝােতার পদ্ধতি, বিভিন্নতার মাঝে ঐক্য সাধনের পদ্ধতি। পাকিস্তানে ১৯৪৭ সাল হতে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক এলিটগণ সর্বদাই প্রথমােক্ত পদ্ধতিটি অনুসরণ করেছেন। পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষত পূর্ববাংলার আঞ্চলিক ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্র্যকে জোরপূর্বক মন দিয়ে অঞ্চলগুলাের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অস্বীকার করে একটি অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তােলার প্রচেষ্টার ফলেই পাকিস্তানের শাসক এলিটগণ জাতি গঠনকার্যে এবং জাতীয় সংহতি অর্জনের ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। পূর্ববাংলার প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্যের নীতি অনুসরণ এবং বিশেষ করে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার ফলে এ অঞ্চলে নবসৃষ্ট এ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তথা রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার ফলে পূর্ববাংলা মধ্যে বিচ্ছিন্নতার ভাব দেখা দেয়, শাসক এলিটগণ এ অঞ্চলের জনগণের নিকট হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পূর্ববাংলার আঞ্চলিকতাবাদ বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপ পরিগ্রহ । ততকালীন পাকিস্তানে জাতীয় সংহতির তথা একাত্মতার সংকটের কোন মীমাংসাই হয় নি।
২। বৈধতার সংকট (The Legitimacy Crisis)ঃ ততকালীন পকিস্তানে এ সঙ্কটও মারাত্মকভাবে বিরাজমান ছিল প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম এক দশক শাসক এলিটগণ জনসমর্থন হারিয়েও জোর করে বা নানা কৌশলের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়াস পান। প্রথম দশকে সমগ্র দেশ ভিত্তিতে একটিও সাধারণ অনুষ্ঠিত হয় নি। শাসক এলিটগণ নানা টালবাহানা করে নির্বাচন অনুষ্ঠান বন্ধ রাখেন। ১৯৫৬ শাসনতন্ত্র অনুযায়ী একটা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সাজি শাসন জারির ফলে তা সম্ভবপর হয় নি। এ দিকে ক্ষমতাসীন এলিটগণ জনসমর্থন হারিয়ে বসেন। সুতরাং বৈধতার সঙ্কট দেখা দেয়। পাকিস্তানের দ্বিতীয় দশকে দু'বার সামরিক শাসন জারি হয় এবং তা দীর্ঘকাল ধরে বজায় থাকে। ১৯৬২ হতে ১৯৬৯ সালের প্রথম পর্যন্ত আইয়ুবের নিয়ন্ত্রিত গণতন অর্থাৎ মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় জনগণের প্রকৃত কোন ভােটাধিকার ছিল না। ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রী সমন্বয়ে একটা পৃষ্ঠপােষকতানির্ভর দুর্নীতিপূর্ণ রাজনৈতিক কাঠামাে সৃষ্টি করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রয়ােগ ও মতামত প্রকাশের তেমন কোন সুযােগ ছিল না। প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায় অংশগ্রহণের সুযােগ ছিল না এবং সর্বোপরি এর মাধ্যমে আইয়ুবের একনায়কত্বকে চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জনগণ এ ব্যবস্থাকে মেনে নেয় নি এবং শেষ পর্যন্ত আইয়ুবের পৃষ্ঠপােষকতার রাজনীতি ‘বৈধতার সংকটের সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। এ ছাড়া, পাকিস্তানি শাসক এলিটগণ সর্বদাই ইসলামি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তােলার মতবাদকে বৈধতার সূত্র হিসেবে চালানাের চেষ্টা করলে তা মােটেই সফল হয় নি।
৩। অংশগ্রহণের সংকট (The Participation Crisis) ঃ বিগত পাকিস্তান আমলে দেশের রাজনীতিতে স্বভাবতই অংশগ্রহণের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল এবং বিশেষত আইয়ুবী দশকে তা চরম আকার ধারণ করে। আইয়ুবের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে আশা করা হয়েছিল যে, উন্নয়ন কার্যের জন্য বিশেষত গ্রামাঞ্চলের ব্যাপক জনগণকে সংঘবদ্ধ করা যাবে এবং স্থানীয় বিষয়সমূহকে কার্যকর অংশগ্রহণের একটি চেতনা তারা লাভ করবে। অবশ্য সমাবেশকরণ ও অংশগ্রহণের সুযােগ হবে সীমিত, নিয়ন্ত্রিত ও নির্দেশিত যাতে নতুন রা ব্যবস্থার উপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি না হয়। এ ব্যবস্থাধীনে শুধুমাত্র মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচন সংক্রান্ত অধিকার প্রদান করে জাতীয় রাজনীতিতে সর্বজনীন অংশগ্রহণকে সীমিত করে দেয়া হয়। মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা সৃষ্টির পশ্চাতে সবচেয়ে প্রধান বিবেচনা ছিল যে, এটা আইয়ুবী শাসনকে" বৈধতা দানে সহায়তা করবে। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র অনুযায়ী শহরাঞ্চলের জন্সাধারণকে ভােটাধিকার হতে বঞ্চিত করা হয় এবং গ্রামাঞ্চলের জনগণকে ভােটাধিকার দেয়া শেষােক্তদের এ ভােটাধিকারও প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন ছিল। মৌলিক গণতন্ত্র অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ও কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যগণ সরাসরি জনগণের ভােটে নির্বাচিত হতেন না। স্থানীয় শাসন পরিচালনার ন্য নির্বাচিত তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রীগণ তাদেরকে নির্বাচিত করতেন। তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভােটে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের হাতেও কোন প্রকার ক্ষমতা ছিল না,পূর্ব বাংলার রাজনীতিবিদগণের মতে ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এটাই প্রমাণ করে যে, মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে আইয়ুব খানকে অপসারিত করে প্রকৃত গণতন্ত্র ও আঞ্চলিক অর্জন সম্ভব ছিল না। তাদের মতে মৌলিক গণতন্ত্র ছিল আইয়বের একনায়কত্বকে র জন্য এক সাংবিধানিক প্রহসন। আইয়ুব খানের পৃষ্ঠপােষকতায় তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রীগণ একটি বিশেষ স্বার্থ ও সুবিধাভােগী শ্রেণীতে পরিণত হয় এবং এ প্রথার কোনরূপ পরিবর্তন তাদের নিকট গ্রহণযােগ্য ছিল না। বস্তুত পাকিস্তানের রাজনীতিতে ও শাসন পরিচালনায় পূর্ববাংলার যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অভাব, অর্থাৎ অংশগ্রহণের অভাব বা অনুপস্থিতিই পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট করার একটা অন্যতম প্রধান কারণ।
৪। অনুপ্রবেশের সংকট (The Penetration Crisis)ঃ বিগত পাকিস্তান আমলে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশের সঙ্কট বিদ্যমান ছিল। সরকার ও জনগণের মধ্যে তথা শাসক এলিট ও শাসিতের মধ্যে একটা বিরাট ব্যবধান ছিল। এ ব্যবধান ছিল দৃষ্টিভঙ্গির, এ ব্যবধান ছিল আশা-আকাঙ্ক্ষার। একদিকে জনগণের সংকীর্ণ চেতনা ও অন্যদিকে শাসকগােষ্ঠীর অ-যথার্থ নীতি ও উপর হতে চাপিয়ে দেয়া ব্যবস্থার ফলে সরকার জনসমাজের ভিতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বিশেষত গ্রামের জনগণ ও সরকারের মধ্যকার শূন্যতা (Gap) ছিল অপরিসীম। সরকার পুরাতন কাঠামােকে ভেঙ্গে ফেলতে এবং জনগণের মূল্যবােধ ও অভ্যাসের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনয়নে সচেষ্ট হয়েছিলেন যা আবার অংশগ্রহণের সংকট ডেকে এনেছিল। । অন্যভাবে বলা যায়, অংশগ্রহণের সংকটের সমাধান করতে না পারায় জনগণ সরকার হতে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং সে কারণে অনুপ্রবেশের সংকটের মােকাবিলা করাও সম্ভব হয় নি।
৫। বন্টন সংকট (The Distribution Crisis) ঃ বিগত পাকিস্তান আমলে দেশে বন্টন সমস্যা ছিল প্রকট। পাকিস্তানের প্রথম হতে এ সংকট অনেকটা বিরাজমান থাকলেও দ্বিতীয় দশকে অর্থাৎ আইয়ুবের শাসনামলে সংকট অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ করে। সমস্যা দেখা দেয় দুই পক্ষে প্রথমত, একটা বিশেষ শ্রেণী বা কতিপয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয় এবং দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক বৈষম্য তথা পূর্ববাংলার ক্ষেত্রে পর্বত প্রমাণ বৈষম্য দেখা দেয়। আইয়ুৰী শাসনামলে ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে নীতি অনুসরণ করা হয় তার ফলে ১৯৬৮ সাল নাগাদ অর্থনৈতিক ক্ষমতার এত বেশি কেন্দ্রীকরণ ঘটে যে, দেশের সকল শিল্প মুনাফার ৬৬ ভাগ, ইনসিওরেন্স তহবিলের শতকরা ৯৭ ভাগ, ব্যাংকসমূহের শতকরা ৮০ ভাগ মাত্র ২২ টি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তারা সকলেই ছিল অবাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক।
মুষ্টিমেয় পরিবারের মধ্যে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ইনকাম গ্রুপগুলাের ভিতর ব্যক্তিগত আয় বণ্টনের ক্ষেত্রেও অসমতা বৃদ্ধি পায়। আবার পকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অসম অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক উন্নয়নকে দারুণভাবে ব্যাহত করে। ১৯৬৬-৬৭ সালে মােট পণ্যদ্রব্যের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রস্তুত হয় পূর্ব পকিস্তানে এবং দুই-তৃতীয়াংশ প্রস্তুত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের পরিমাণ দাঁড়ায় শতকরা ২৪ ভাগ। ফলে আইয়ুবী শাসনামলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন উল্লেখযােগ্য পরিমাণে হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত তীব্র বন্টন সংকট দেখা দেয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, পৃথিবীর সকল উন্নয়নশীল দেশেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকট দেখা দেয়। তবে তাদের মধ্যে পাকিস্তানই অধিকতর সংকটের মােকাবিলা করেছে। প্রথম দশকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক উন্নয়ন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সংকট ও অনুপ্রবেশের সংকট বিদ্যমান ছিল। দ্বিতীয় দশকে অর্থাৎ আইয়ুবী শাসনামলে একাত্মতার সংকট তাে ছিলই, উপরন্তু বৈধতার সংকট, ' বণ্টনের সংকট এবং অংশগ্রহণের সংকটসহ আরাে অনেক সমস্যা অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। এসব সংকট ১৯৬৮ সালের নভেম্বর হতে ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানে একটি ক্রম বর্ধিষ্ণু বিপ্লবের জন্ম দেয়, যা আইয়ুবী শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় এবং পরিশেষে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংহতির ভিত্তিমূলে আঘাত করে।
0 Comments