বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা .. মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা .. 



Declaration of Independence by Bangabandhu 

 স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আর সেজন্য ২৬ মার্চ, দিনটি বাঙালি জাতির জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। মূলত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পর
থেকে এদেশে প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং ৯ মাসের ব্যবধানে ১৬ ডিসেম্বর এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। আর আমরা | লাভ করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা এদেশের মুক্তিসংগ্রামের সকল প্রেরণার উৎস।


(ক) ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘােষণা 
 '' হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনত যুদ্ধঃ দলিলপত্র’ শীর্ষক ১৫ খণ্ডে রচিত গন্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংক্রান্ত দলিলপত্র ও তথ্য সকলিত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত স্বাধীনতা ঘােষণার বাণীটি উক্ত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর লিখিত উক্ত গ্রন্থ অত্যন্ত মূল্যবান দলিল। উক্ত গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১ম পৃষ্ঠায় শেখ মুজিব প্রদত্ত বাণীটি সন্নিবেশিত রয়েছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট' নামে যখন পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে মত্ত, বঙ্গবন্ধু তখনই স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ব-বন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার দু'টি বার্তা বা বাণী পাওয়া যায়।

প্রথম বার্তা বা বাণী  ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্য রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার পূর্বক্ষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার একটি ইংরেজি বার্তা ইপিআর-এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে পৌছে দেন। ঘােষণার বার্তা বা বাণীটি ছিল নিম্নরূপঃ

This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved."  “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। এই আমার শেষ কথা। যে যেখানেই থাকুন না কেন সকলের প্রতি আমার আবেদন রইল, যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর মােকাবিলা করুন এবং বাংলার মাটি থেকে পাক দখলদার বাহিনীকে সমূলে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়ে যান।”

দ্বিতীয় বার্তা বা বাণী  বঙ্গবন্ধু এরপর ঢাকার টিএন্ডটি মারফত আরও একটি স্বাধীনতা ঘােষণার বার্তা বা বাণী পাঠান। দ্বিতীয় বার্তা বা বাণীটি ছিল নিম্নরূপঃ

Declaration of War of Independence 
Pak army suddenly attacked EPR base at Pilkhana and Rajarbag police line killing citizens, street battles are going on in every streets of Dacca, Chittagong. I appeal to the nations of the world for help. Our freedom fighters are gallantly fighting with the enemies to free the motherland. I appeal and order you all is the name of Almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask police, EPR, Bengal Regiment and Ansar to stand by you and to fight, no compromise, victory is ours. Drive out the enemies from the holy soil of the motherland. Convey this message to all Awami League leaders, workers and other patriots and lovers of freedom. May Allah bless you."

Joy Bangla 
Sheikh Mujibur Rahman

 “পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিত পিলখানায় ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লােকদের হত্যা করছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন। করছি। আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা বীরত্বের সাথে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শক্রদের সাথে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনাে আপােস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা প্রিয় লােকদের এ সংবাদ পৌছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।

শেখ মুজিবুর রহমান
 ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সাল


 স্বাধীনতার জন্য প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বঙ্গবন্ধুর উপরােক্ত আহ্বান সম্বলিত বার্তাও পৌছে যায় বাংলার আনাচে, কানাচে। তিনি এবং চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব এম. এ. হান্নান এ স্বাধীনতার ঘােষণা বার্তার বঙ্গানুবাদ করেন। সে রাতেই তা সাইক্লোস্টাইল করে চট্টগ্রাম শহরে জনগণের মধ্যে বিলি করে দেয়া হয় এবং মাইকযােগে তা প্রচার করা হয়। ২৬ মার্চ সকালেই স্বাধীনতার এ ঘােষণা চট্টগ্রাম শহরের সর্বত্র এবং গ্রামাঞ্চলেও প্রচারিত হয়। ১৯৭১ সালে ঢাকায় নিয়ােজিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর জনসংযােগ অফিসার কর্ণেল সিদ্দিক সালিক-এর মতেঃ

"Soon after darkness fell on March 25 (1971) the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to the official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like, a pre-recorded message, Sheikh Mujib proclaimed East Pakistan to be the Peoples Republic of Bangladesh. He called on Bengali to go underground, to reorganise and to attack the invaders."

 পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উক্তি থেকে একটি কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেস যােগে দেশবাসীর কাছে স্বাধীনতার ঘােষণা পৌছে দেয়ার পরই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের বেলাল মােহাম্মদ, সুলতান আলী ও অন্যান্যের সাথে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আলােচনার পর বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ২৬ মার্চ দুপুর প্রায় ২টা ৩০ মিনিটের সময় জনাব এম. এ. হান্নান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে (আগ্রাবাদ) সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। এ সময় তার পাশে ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সার, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মােশাররফ হােসেন এবং আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ আবু জাফর, আবদুল মান্নান প্রমুখ।

ড. অজয় রায় উল্লেখ করেন যে, ।

“উক্ত বাণীটি দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ইপিআর স্টেশনসহ চট্টগ্রামের সলিমপুর (কোস্টাল) ওয়ারলেস স্টেশনেও ধরা পড়েছিল। এখানকার কর্মকর্তা কর্মচারীরা সে সময় বঙ্গবন্ধুর বাণীটির গুরুত্ব অনুধাবন করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে প্রেরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ও চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পৌছে দিয়েছিলেন। এরই ফলে কোলকাতায় কোস্টাল রেডিও স্টেশনে (VWC) এই বাণীটি ধরা পড়ে। যার ভিত্তিতে বার্তা সংস্থা ইউ, এন. আই’র বরাত দিয়ে বিখ্যাত ‘স্টেটম্যান পত্রিকা শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণার সংবাদ ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সালে পরিবেশন করেছিল।”

২৬শে মার্চ দুপুরে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে এম. এ. হান্নান। যে ঘােষণা দেন তা ছিল নিম্নরূপঃ

“আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ও তার নামে বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা করছি। আপনারা যারা এ গােপন রেডিও হতে আমার এই ঘােষণা শুনছেন তারা অন্যদের নিকট এই বাণী প্রচার করবেন। আর যার নিকট যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করুন এবং দেশকে মুক্ত করুন।

আগ্রাবাদে অবস্থিত বেতার কেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরে নােঙ্গর করা যুদ্ধ জাহাজের শেলিং আওতার মধ্যে থাকায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কালুরঘাট ট্রান্সমিটার সেন্টারে স্থাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিট থেকে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটিং সেন্টার থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মতৎপরতা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সম্পর্কিত ঘােষণার বাংলা অনুবাদ উপস্থাপন করেন আবুল কাশেম সন্দীপ। এরপর মূল ইংরেজি ভাষণ পাঠ করেন ওয়াপদার তৎকালীন প্রকৌশলী আশিকুল ইসলাম। এরপর জনাব আঃ হান্নান এ বেতারে কেন্দ্র থেকেই আবারাে স্বাধীনতার ঘােষণা সম্পর্কে তার ভাষণ বেতার প্রচার করেন।


(খ) ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানের ঘােষণা :

আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা একজন সামরিক কর্মকর্তার দ্বারা পাঠ করার গুরুত্ব অনুধাবন করেন। নিকটস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে পদমর্যাদায় সিনিয়র মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠের জন্য অনুরােধ জানানাে হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। তিনি ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। ২৮ এবং ৩০ মার্চ, আবারও তিনি কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন।

জিয়াউর রহমান ৩০ মার্চ পর্যন্ত বহুবার ঘােষণাটি প্রচার করেন। | হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র শীর্ষক গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ২য় পৃষ্ঠায় এ ঘােষণাটি লিপিবদ্ধ রয়েছে। তার ঘােষণাটি ছিল ইংরেজিতে তবে পাদটীকায় মন্তব্য করা হয়েছে যে, “মেজর জিয়াউর রহমানের ২৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠের ঐতিহাসিক মূল কপিটি নিরাপত্তার কারণে নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল।” ঘােষণাপত্রটি ছিল নিম্নরূপ :

"I Major Zia, Provisional Commander-in-Chief of the Bangladesh Liberation Army, hereby proclaims, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh.

I also declare, we have already framed a sovereign, Legal government under Sheikh Mujibur Rahman which pledges to Function as per law and the constitution. The new democratic Government is committed to a policy of non-alignment is international relations. It will Seek Friendship with all nations and strive for international peace. I appeal to all government of mobilize public opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh.

The Government under Sheikh Mujibur Rahman is Sovereign Legal Government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic national.of the world.")8

আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক, এতদ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করছি।

আমি আরও ঘােষণা করছি, আমরা ইতিমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও বৈধ সরকার গঠন । করেছি। এই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় আইন এবং শাসনতন্ত্র মেনে চলায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ সরকার সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বের প্রত্যাশী এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য চেষ্টা করবে। আমি সকল সরকারের কাছে আবেদন করছি তারা যেন বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের নিজ নিজ দেশে জনমত গড়ে তােলেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে গঠিত সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌম ও বৈধ সরকার এবং এই সরকার পৃথিবীর সকল ও গণতান্ত্রিক দেশের স্বীকৃতি লাভের অধিকার সংরক্ষণ করে।
 মেজর জিয়াউর রহমানের ঘােষণাটি ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে ইংরেজিতে পাঠ করেন। কিছুক্ষণ পর পর পুনঃপুন' প্রচারিত হতে থাকে। অবশ্য এর মধ্যে এই ঘােষণার বাংলা অনুবাদও প্রচারিত হতে থাকে।

' মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদান সঙ্গে আবুল মাল আবদুল মুহিত উল্লেখ করেছেন যে, 
“পরের দিন ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাটে তার সেনাবাহিনী মােতায়েন করেন। বেতারকর্মীরা এই বিদ্রোহী সেনানায়ককে স্বাধীনতা ঘােষণা পাঠ করতে আহ্বান জানান। মেজর জিয়া ঘােষণা করে বসলেন যে, তিনিই অস্থায়ী সরকার প্রধান এবং তিনি ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সারা বিশ্বের সমর্থনের আবেদন জানান।  এই ঘােষণায় কিছু ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়,... অবশ্য পরে ২৮ মার্চ মেজর জিয়া অপর একটি বেতার ঘোষণায় পরিস্কার করে জানালেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘােষণার সমর্থনে তার সেনাবাহিনীকে মােতায়েন করেছেন, তিনি বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী প্রধান।
 ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ভারতের ‘দি স্টেটসম্যান' পত্রিকা এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত “দি টাইমস' এবং ‘দি গার্ডিয়ান নামক পত্রিকায় বঙ্গবন্ধৰ স্বাধীনতা ঘােষণার খবর প্রকাশিত হয়। এর ফলে সমগ্র বিশ্ববাসীও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে  অবহিত হন। তবে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘােষণা তৎকালীন পরিস্থিতিতে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলেন। কারণ- যখন হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত বা মৃত এ নিয়ে বাঙালির মনে সংশয় দেখা দিয়েছিল, তখন তার নামে মেজর জিয়ার ঘােষণা মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

জিয়াউর রহমানের ঘােষণাটি তৎকালীন পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত দেশবাসীকে নতুন করে সাহস আর আত্মবিশ্বাসের অভয়বাণী শুনিয়েছিল এবং নব উদ্যোমে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার প্রেরণা যুগিয়েছিল। “মেজর জিয়ার এই ভাষণ ছিল একটি সুচিন্তিত উপস্থাপনা এবং একই সাথে জাতির প্রতি উদাত্ত আহ্বান। ২৭ মার্চ  মেজর জিয়ার এই ঘােষণা দেশের রাজনৈতিক শূন্যতাকে পূরণে সহায়ক হয়। তার এই ভাষণ বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ সরকারের ভবিষৎ নীতি এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উপস্থাপন করা হয়।"

বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার

Arrest of Bangabondhu 
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ, ঘড়িতে তখন সময় রাত ১টা। একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া যান এবং সৈন্য বোঝাই একটি ট্রাক ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং বাড়ির সামনে এসে পৌছায়। গ্রেনেট ফাটিয়ে এবং পিস্তলের গুলি ছুঁড়ে জানিয়ে দেয় তাদের আগমনের উদ্দেশ্য। | অবশ্য, বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতেই মােটামুটি নিশ্চিত ছিলেন, তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। সেজন্য রাত ৮ টার দিকে বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ডেকে তাড়াতাড়ি ঢাকা ত্যাগ করে চলে যেতে বলেন এবং যাকে যেভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেভাবে কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে আত্মেগােপন না করে বাসভবনে অবস্থান করা প্রসঙ্গে বলেন ,

“আমাকে ওরা গ্রেফতার করতে পারলে আর বেশি বাড়াবাড়ি করবে না। আর যদি আমাকে গ্রেফতার করতে না পারে তবে আমাকে গ্রেফতার করার জন্য পাকবাহিনী সারা বাংলা চষে বেড়াবে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিবে। নির্বিচারে আমার লােকজনকে হত্যা করবে। আমি আমার নিরস্ত্র মানুষকে জল্লাদের হাতে তুলে দিতে পারি না। আমার রক্ত দিয়ে হলেও আমি আমার লােকজনকে বাচাব। তাছাড়া আমি এখান থেকে পালিয়ে গেলে ইয়াহিয়া খান ও তার সঙ্গীরা নানা কুৎসা রটাবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভ্রান্তি ছড়ানাের পাঁয়তারা করবে। আমাকে হত্যা করলে জাতির মনােবল নষ্ট হবে না বরং আরও শক্তিশালী হবে। গড়ে উঠবে আরও শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য।” 
 এম. এ. হাসান বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়ার বর্ণনা দেন এভাবে, “রাত ১.১০ মিনিটে বঙ্গবঙ্গকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে তাদের বলেন, তাকে বললেই হবে', তিনি নিজেই যাবেন। এতদসত্তেও হাবিলদার মেজর খান ওয়াজিব নামক একজন সুবেদার বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করার চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধু দৃঢ় অবিচল থেকে তার পাইপটি নেন এবং তার পরিবারকে বিদায় নেন। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে ১৪ ডিভিশন অফিসার্স মেসে রাখা হয়। দ্বিতীয়দিন জেনারেল:এ.ও. মিটঠা খানের নির্দেশে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের তৃতীয় তলায় রাখা হয়। সেখান থেকে বন্দী অবস্থায় তাকে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া  হয়। পরে বঙ্গবন্ধুকে মীয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। ১৯৭০ সালের ১ এপ্রিল বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়। ঢাকায় পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় এই খবর প্রকাশিত হয় ৮ এপ্রিল।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার প্রতিবাদে ২৬ মার্চ থেকে যে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়, তা নয় মাস স্থায়ী হয়। অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘােষণার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এর পরই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তবে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠিত হলে, এ সরকারের পক্ষ থেকে সাংবিধানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ঘােষণা দেয়া হয়। যে কারণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে এগুলােকে সাংবিধানিক দলিল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশােধনীর ১৫০(২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখ হতে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে এই সংবিধান প্রবর্তন হবার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ৭ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ষষ্ঠ তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার টেলিগ্রাম এবং সপ্তম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র হলাে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষণ ও দলিল, যা উক্ত সময়কালের জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি বলে গণ্য হবে।”

বাংলাদেশ সরকার গঠন

Formation of Bangladesh Government 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিবনগর সরকার গঠন। এ সরকার ‘প্রবাসী সরকার’ বা ‘বিপ্লবী সরকার’ নামেও পরিচিত। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে জারিকৃত ‘স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের মাধ্যমে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়। একটি নিয়মিত সরকারের লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকে সুচারুরূপে পরিচালনার উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়েছিল। এ সরকারের প্রত্যেক্ষ তত্ত্বাবধানে মুক্তিসেনারা তাদের প্রাণশক্তি ফিরে পায় এবং বীর বিক্রমে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে যেভাবে এই সরকার গঠন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একদিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, অন্যদিকে | এক কোটির উপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণ ব্যবস্থা করা, দেশের অভ্যন্তর থেকে লক্ষ লক্ষ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা যুবাদেরকে যুব শিবিরে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি; স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বদ্ধ রাখা এবং সাথে সাথে সারা বিশ্বে আলােড়ন সৃষ্টি এসবই ছিল প্রবাসী সরকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি যা  সমকালীন ইতিহাসের বিচারে অতুলনীয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post