সক্রেটিস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান




জীবন ও কর্ম

সক্রেটিস নিজের সম্পর্কে কিছু লিখেছেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার জীবনী জানার জন্য তিনটি উৎসের উল্লেখ করা হয়- প্লেটোর ডায়ালগ, এরিস্টোফেনিসের নাটক এবং জেনোফেনোর ডায়ালগগুলো। এরিস্টোফেনিসের নাটক দ্য ক্লাউডে সক্রেটিসকে দেখানো হয়েছে একজন ভাঁড় হিসেবে যিনি তার ছাত্রদের শিক্ষা দেন কিভাবে ঋণের দায় থেকে বুদ্ধি খাটিয়ে মুক্তি পাওয়া যায়। এ রচনায় সক্রেটিসকে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণযোগ্য নয়।

প্লেটোর বর্ণনামতে, সক্রেটিসের বাবার নাম সফ্রোনিস্কাস এবং মায়ের নাম ফিনারিটি যিনি একজন ধাত্রী ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম জানথিপি। তাদের তিন পুত্রসন্তানের নাম- লামপ্রোক্লিস, সফ্রোনিস্কাস এবং মেনেজেনাস। সক্রেটিস তার শাস্তি কার্যকর হওয়ার আগে পালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ ফিরিয়ে দেন।

সক্রেটিসের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ অব্দে গ্রিসের এথেন্স নগরীতে এলোপাকি গোত্রে। তিনি ঠিক কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন তা পরিষ্কার জানা যায় না। কিছু উৎস অনুসারে প্রথম জীবনে তিনি তার বাবার পেশা অবলম্বন করেছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন ভাস্কর। অপরদিকে সক্রেটিস কোনো পেশা অবলম্বন করেননি এমন প্রমাণও রয়েছে। জেনোফোন রচিত সিম্পোজিয়ামে সক্রেটিসকে বলতে শোনা যায়, তিনি কখনও কোনো পেশা অবলম্বন করবেন না। কারণ তিনি ঠিক তা-ই করবেন যাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন আর তা হচ্ছে দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা। এরিস্টোফেনিসের বর্ণনায় দেখা যায় সক্রেটিস শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নিতেন এবং গ্রিসের চেরিফোনে একটি সোফিস্ট বিদ্যালয়ও পরিচালনা করতেন। প্লেটোর অ্যাপোলজি এবং জেনোফোনের সিম্পোজিয়ামে দেখা যায় সক্রেটিস কখনই শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নেননি। প্লেটোর ডায়ালগগুলোর বিভিন্ন জায়গায় লেখা হয়েছে, সক্রেটিস কোনো একসময় সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। প্লেটোর বর্ণনায় সক্রেটিস বলেন, তিনি তিন তিনটি অভিযানে এথেনীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে অংশ নিয়েছেন। এ অভিযানগুলো সংঘটিত হয়েছিল যথাক্রমে পটিডিয়া, অ্যাম্ফিপোলিস এবং ডেলিয়ামে। ডেলিয়ামের যুদ্ধে তার অসাধারণ অবদানের কথা লাকিস নামক রচনাতেও বর্ণনা করা হয়েছে। মাঝে-মধ্যেই সক্রেটিস বিচারালয়ের সমস্যাকে যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, একজন বিচারক দর্শন থেকে সরে আসবেন কিনা তা ভেবে দেখা তেমনই প্রয়োজন যেমন উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করবে কিনা তা একজন সৈনিকের ভেবে দেখা প্রয়োজন।

সক্রেটিস দেখতে মোটেও সুদর্শন ছিলেন না। টাকবিশিষ্ট মাথা। চ্যাপ্টা অবনত নাক। ছোট ছোট চোখ। স্ফীত উদর এবং অস্বাভাবিক গতিভঙ্গি। দেহের শ্রী তেমন না থাকলেও তার রসবোধ ছিল প্রখর। রঙ্গ করে প্রায়শই বলতেন, নাসারন্ধ্রটি বড় হওয়ায় ঘ্রাণ নেয়ার বিশেষ সুবিধা হয়েছে। নাকটি বেশি চ্যাপ্টা হওয়াতে দৃষ্টি কোথাও বাধা পায় না।’

কথাবার্তা ও আচার-আচরণে তিনি ছিলেন মধুর ব্যক্তি। যিনি তার সঙ্গে কথা বলতেন তিনিই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। অধিকাংশের বর্ণনামতে তিনি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রদান করতেন না। রাস্তাঘাট, হাটবাজারই ছিল তার শিক্ষায়তন। দর্শন অনুশীলন করতে গিয়ে সংসার ও জীবিকা সম্পর্কে খুবই উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এ কারণে শেষ জীবনে তার পুরো পরিবারকেই দারিদ্র ও অনাহারের মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। বেশিরভাগ সময়েই তিনি শিষ্যদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করতেন। স্ত্রী জানথিপির কাছে তিনি ছিলেন অবজ্ঞার পাত্র। জানথিপি প্রায়ই বলতেন, তার নিষ্কর্মা স্বামী পরিবারের জন্য সৌভাগ্য না এনে দুঃখ কষ্টই এনেছেন বেশি। তবে বাইরে যতই তিক্ততা থাকুক অন্তরের অন্তস্থলে স্বামীর জন্য অগাধ ভালোবাসা ছিল জানথিপির।

বিচার ও মৃত্যু

এথেনীয় সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতার যুগ থেকে পেলোপনেশীয় যুদ্ধে স্পার্টা ও তার মিত্রবাহিনীর কাছে হেরে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টাই সক্রেটিস বেঁচে ছিলেন। পরাজয়ের গ্লানি ভুলে এথেন্স যখন আবার থিতু হওয়ার চেষ্টা করছিল তখনই জনগণ একটি কর্মক্ষম সরকার পদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রের সঠিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছিল। সক্রেটিসও গণতন্ত্রের একজন সমালোচক হিসেবে আÍপ্রকাশ করেন। তাই

অনেকে সক্রেটিসের বিচার ও মৃত্যুকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

এথেনীয় সরকার সক্রেটিসকে এমন দোষে দোষী বলে

সাব্যস্ত করেছিল যাতে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায়। কিন্তু তার গুণাবলী ও সত্যের প্রতি অটল মনোভাব সত্যিকার অর্থেই তৎকালীন সরকারি নীতি ও সমাজের সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টিতে ইন্ধন যুগিয়েছিল। সক্রেটিস সরাসরি বা অন্য কোনোভাবে বিভিন্ন সময়ে স্পার্টার অনেক নীতির প্রশংসা করেছেন। অথচ স্পার্টা ছিলেন এথেন্সের ঘোর শত্র“। এসব সত্ত্বেও ঐতিহাসিকভাবে সমাজের চোখে তার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রগুলো নিয়ে তীব্র সমালোচনা। প্লেটোর মতে, সক্রেটিস সরকারের জন্য একটি বিষফোড়ার মত কাজ করেছিলেন যার মূলে ছিল বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ভালোর উদ্দেশ্য নিয়ে সমালোচনা। এথেনীয়দের সুবিচারের প্রতি নিষ্ঠা বাড়ানোর চেষ্টাকেই তার শাস্তির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

প্লেটোর অ্যাপোলজি গ্রন্থের ভাষ্যমতে, সক্রেটিসের বন্ধু চেরিফোন একদিন ডেলফির ওরাক্লের কাছে গিয়ে প্রশ্নে করেন, সক্রেটিসের চেয়ে প্রাজ্ঞ কেউ আছে কিনা। উত্তরে ওরাক্ল জানান, সক্রেটিসের চেয়ে প্রাজ্ঞ কেউ নেই। এর পর থেকেই সক্রেটিসকে সমাজের চোখে একজন রাষ্ট্রীয় অপরাধী ও সরকারের জন্য বিষফোড়া হিসেবে দেখা হতে থাকে। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, ওরাক্লের কথাটি ছিল নিছক হেঁয়ালি। কারণ ওরাক্ল কখনও কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে জ্ঞান অর্জনের কারণে প্রশংসা করেন না। এটি আদৌ হেঁয়ালি ছিল কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য সক্রেটিস সাধারণ এথেনীয়রা যে লোকদের জ্ঞানী বিবেচনা করতেন তাদের কাছে গিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে শুরু করেন। তিনি এথেন্সের মানুষদের উত্তম, সৌন্দর্য এবং গুণ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তর শুনে তিনি বুঝতে পারেন এদের কেউ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানেন না কিন্তু মনে করেন, তারা সব জানেন। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হন- সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানী যিনি, তিনি যা জানেন না তা জানেন বলে কখনও মনে করেন না। তার এ ধরনের হেঁয়ালিসূচক প্রজ্ঞা ও জ্ঞান তখনকার সনামধন্য এথেনীয়দের বিব্রত অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। কারণ তারা কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারতেন না। এ থেকেই সবাই তার বিরোধিতা শুরু করেন। এছাড়াও সক্রেটিসকে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে চরিত্রহীনতা ও দুর্নীতি প্রবেশ করানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। সব অভিযোগ বিবেচনায় এনে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। মৃত্যুর উপায় নির্দিষ্ট হয় হেমলক বিষ পান। বিষ পানের পর সক্রেটিসকে হাঁটতে আদেশ করা হয় যতক্ষণ না তার পা দুটো ভারী মনে হয়। শুয়ে পড়ার পর যে লোকটি সক্রেটিসের হাতে বিষ তুলে দিয়েছিল সে তার পায়ের পাতায় চিমটি কাটে। সক্রেটিস সে চিমটি অনুভব করতে পারেননি। তার দেহে অবশতা নেমে আসে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর পূর্বে তার বলা শেষ বাক্য ছিল- ‘ক্রিটো, আমাদের কাছে অ্যাসক্লেপিয়াস একটি মোরগ পান, তার ঋণ পরিশোধ করতে ভুলো না যেন।’ অ্যাসক্লেপিয়াস হচ্ছেন গ্রিকদের আরোগ্য লাভের দেবতা।

সক্রেটিসের দার্শনিক পদ্ধতি

সক্রেটিস দার্শনিক জেনোর মতো দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এই পদ্ধতিতে প্রথমে প্রতিপক্ষের মত স্বীকার করে নেয়া হয়, কিন্তু এর পর যুক্তির মাধ্যমে সেই মতকে খণ্ডন করা হয়। এই পদ্ধতির একটি প্রধান বাহন হল প্রশ্ন-উত্তর। সক্রেটিস প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমেই দার্শনিক আলোচনা চালিয়ে যেতেন। প্রথমে প্রতিপক্ষের জন্য যুক্তির ফাঁদ পাততেন এবং একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকতেন। যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ পরাজিত হয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে নেয় ততক্ষণ প্রশ্ন চলতেই থাকত। সক্রেটিসের এই পদ্ধতির অপর নাম সক্রেটিসের শ্লেষ।

সক্রেটিসের সেরা উক্তি

* নিজেকে জানো।

* টাকার বিনিময়ে শিক্ষা অর্জনের চেয়ে অশিক্ষিত থাকা ভালো।

* তারা জানে না যে তারা জানে না, আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না।

* পৃথিবীতে শুধু একটিই ভালো আছে, জ্ঞান। আর একটিই খারাপ

আছে, অজ্ঞতা।

* পোশাক হল বাইরের আবরণ, মানুষের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে তার জ্ঞান।

* আমি কাউকে কিছু শিক্ষা দিতে পারব না, শুধু তাদের চিন্তা করাতে পারব।

* বিস্ময় হল জ্ঞানের শুরু।

* বন্ধু হচ্ছে দুটি হৃদয়ের একটি অভিন্ন মন।

* সেই সাহসী যে পালিয়ে না গিয়ে তার দায়িত্বে অটল থাকে এবং

শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।

* তুমি যা হতে চাও তা-ই হও।

Post a Comment

Previous Post Next Post