প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার কতিপয় -২

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সভ্যতার উদ্ভব মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন। সভ্যতার ক্রমান্বয়ে উন্নতির ফলেই মানুষের জীবনযাত্রা সহজ থেকে সহজতর হয়েছে। আজকের আধুনিক যুগও সভ্যতার কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে। বন্যতা থেকে বর্বরতা এবং বর্বরতা থেকে মানুষ ধীরে ধীরে সুশৃংঙ্খল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। মানবগোষ্ঠী তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা জীবন প্রবাহের মানোন্নয়ন করতে থাকে। বিশেষ সময়-কালের পরিপ্রেক্ষিতে তা সভ্যতা নামে অভিহিত হয়। প্রাচীন কালে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সভ্যতা গড়ে ওঠে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সভ্যতা নিচে তুলে ধরা হলো।

হিব্রু সভ্যতা :

হিব্রু সভ্যতার উৎস ভূমি মধ্যপ্রাচ্যে। এ সভ্যতা আজকের ফিলিস্তিন ও ইসরাইল অঞ্চল কেন্দ্রিক গড়ে ওঠেছিল। জাতিগত ভাবে হিব্রুরা ছিল একটি মিশ্রিত জাতি। কুটনীতি, স্থাপত্য এবং চিত্রকলার দিক থেকে হিব্রুরা সভ্যতার ইতিহাসে খুব অল্পই ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু নৈতিকতা ও ধর্মীয়ক্ষেত্রে বিশ্বসভ্যতায় হিব্রুদের অবদান ছিল যুগান্তকারী। হিব্রুদের মূল নামের উৎপত্তিগত শব্দ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। প্রচলিত একটি মতে, খাবিরু বা হাবিরু নাম থেকেই হিব্রু হয়েছে। হিব্রু অর্থ বিদেশী, নিম্নবংশীয় বা যাযাবর। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতেই হিব্রুদের আদিবাস ছিল আরবভূমিতে। তাদের প্রথম বসতি গড়ে ওঠে উত্তর-পশ্চিম মেসোপটেমিয়াতে। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দে ইব্রাহীম (আ:) এর নেতৃত্বে হিব্রুদের একটি দল এখানে বসতি গড়ে তোলে। পরবর্তীতে ইব্রাহীম (আ:) এর ছেলে ইসমাইল (আ:) এর নেতৃত্বে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় থেকে তারা ইসরাইলি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
খ্রিস্টধর্মের পটভূমি তৈরিতে হিব্রুধর্মের ভূমিকাই ছিল বেশি। সৃষ্টিতত্ব, ঈশ্বরের একাত্ম, সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, আইনপ্রণেতা, ও পরম বিচারক হিসেবে ঈশ্বরের অবস্থান সম্পর্কিত বাইবেলের দুই তৃতীয়াংশে রয়েছে হিব্রু ধর্মের প্রভাব। আইন প্রণয়নেও হিব্রুদের অবদান রয়েছে। প্রাচীন কেনাইট ও ব্যাবিলনীয় আইনদ্বারা প্রভাবিত হয়ে হিব্রু আইন প্রণীত হয়েছিল। ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে হিব্রু আইনের বিভিন্ন ধারা জানা যায়। হিব্রু সাহিত্য প্রাচ্যের যে কোন প্রাচীন সাহিত্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট ছিল। তাদের সাহিত্যে ধর্মের প্রভাব ছিল প্রবল। ওল্ড টেস্টামেন্ট মূলত বিভিন্ন সাহিত্য কর্মের সংকলন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হিব্রুদের তেমন অবদান নেই। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা কিছু অবদান রেখেছে। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে রোগ যন্ত্রনাকে ঈশ্বরের অভিশাপ বলা হয়েছে।

গ্রীক সভ্যতা :

মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে ক’টি দেশের মানুষ তাদের উজ্জ্বল অতীতের জন্য ঈর্ষণীয় গৌরবের অধীকারী গ্রিকরা তাদের অন্যতম । গ্রিক নামটি রোমানদের দেয়া। গ্রিসে জন্ম নিয়েছেন তাদের মধ্যে মহাকবি হোমার, জ্ঞানতাপস সক্রেটিস, স্থাপত্য-ভাস্কর্যের অবিস্মরণীয় দিকপাল ইকটিনাস ও ফিডিয়াস, রাজনীতি মঞ্চের অপ্রতিদ্বন্ধী কৌশলী থেমিস, টকলস, এরিস্টাইডিস ও পেরিক্লিস, সাহিত্যের অনির্বাণ জ্যোতিষ্ক সফোক্লিস, এরিস্টোফেলেস, ইউরিপাইডিস, দর্শনের শিখাগ্নী প্লেটো ও এরিস্টটল, ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস, থুকিডিডিস প্রমুখ মনীষীর আবির্ভাব এই গ্রিক সভ্যতায়। শিল্প, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন ও সাহিত্য প্রতিটি ক্ষেত্রে এর অবদান বিশ্ব সভ্যতায় উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। এ সভ্যতার বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে আকিয়ানসহ দোরিয়ান ও আয়োনিয়ানদের অবদান অনস্বীকার্য। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সাল নাগাদ তারা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে গ্রিসে প্রবেশ করতে শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১১৩০ অব্দ সময়সীমার মধ্যে মিকোনাই, টিরিনস ও পিলস অঞ্চল বিকশিত হয় এক অগ্রসরমান ব্রোঞ্জ সভ্যতায়। গ্রীস সে সময় ছোট বড় কতগুলো স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। গ্রীক সভ্যতা ও সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্যভাবে নগররাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত। এই সভ্যতা বিকাশ লাভ করে প্রথমে ইজিয়ান দ্বীপপুঞ্জে, এশিয়া মাইনরের ইজিয়ান উপকূলবর্তী শহরগুলোতে, এথেন্সে, তারপর সিসিলি, দক্ষিণ ইতালির গ্রিক উপনিবেশগুলোতে গ্রিকদের ধর্ম বিশ্বাস ছিল প্রবল। তাদের দেব-দেবীর সংখ্যাও ছিল অনেক। তাদের বিশ্বাস ছিল, এসব দেব-দেবী তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা। গ্রীক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ কাল হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চাশ শতক থেকে শুরু করে কয়েক দশক পর্যন্ত স্থায়ী এথেন্সে পেরিক্লিসের শাসনামল। এই সময় বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা দর্শন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম সাফল্য অর্জিত হয়। এথেন্স হয়ে ওঠে এই সভ্যতার পীঠস্থান। বিশ্ব সভ্যতার ক্ষেত্রে রঙমঞ্চ বা থিয়েটার প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক অবদান গ্রীকদেরই, ইতিহাস শাস্ত্রের সূচনা হয় প্রাচীন গ্রীস থেকেই। ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রীক দর্শনের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত করেন আলেস। গণিত শাস্ত্রের সূচনা করে পিথাগোরাস অমর হয়ে আছেন। হিপোক্রেটিস চিকিৎসা শাস্ত্রকে কুসংস্কার মুক্ত করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করান।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ-
  • গ্রীক সভ্যতা কোন নদীর তীরে গড়ে উঠেনি।
  • গ্রীকদের অবদান ছিল সভ্যতার সকল ক্ষেত্রে ।
  • গ্রীক সভ্যতায় প্রথম নগর রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে।
  • চিকিৎসা শাস্ত্র, গণিত ও জ্যামিতিতে গ্রীকদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।
  • গ্রীসের রাজধানী এথেন্স।

রোমান সভ্যতা :

রোমান সভ্যতা বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ সভ্যতা। রোম, গ্রীস, কার্থেক ও প্যালেস্টাইন সহ ভূমধ্যসাগর অঞ্চল জুড়ে বিদ্যমান সকল রাষ্ট্রকে এটি যেমন অধিকার করে, তেমনি অধিকৃত রাষ্ট্রসমূহের শিল্প সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণা আত্মস্থ করে নিজস্ব অবদানে তা সমৃদ্ধও করে। বিশ্ব সভ্যতার ক্ষেত্রে রোমান সভ্যতার প্রধানতম অবদান রাজনৈতিক ও সরকার পরিচালনা ব্যবস্থা সংক্রান্ত রীতি পদ্ধতি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে রোম শহরের পত্তন হয়। কালক্রমে টাইবার নদীর মোহনায় সাতটি পার্বত্য টিলাকে কেন্দ্র করে এই নগরীর বিস্তৃতি ঘটে। এই সাতটি নগরীকে নিয়ে পরে গড়ে তোলা হয় একটি একক নগররাষ্ট্র।

খ্রিস্টপূর্ব ২৮০ অব্দ নাগাদ রোমানরা বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে স্বাধীন মিত্রদের একটি শক্তিশালী সংঘ গঠন করে। রোম সাম্রাজ্যকে সুসংহত ও বিস্তৃত করতে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তারা হলেন জুলিয়াস সিজার, পাম্পে দ্য গ্রেট, আউগুস্তুস ও তাইবেরুস। রোমেই প্রথম আবিষ্কৃত হয় কংক্রিট। ফলে বিশাল ও আড়ম্বরপূর্ণ দালান কোঠা, খিলান ও গম্বুজ নির্মাণ করা সম্ভব হয় রোমক ভাস্কর্য শিল্পও এই সমৃদ্ধ সভ্যতার অন্যতম পরিচায়ক। চিকিৎসকগণ ল্যাটিন ভাষায় ঔষুধ পত্রের যে সব নাম লিখে থাকেন, তার মূলে ও রয়েছে এই সভ্যতার অবদান। এছাড়া বছরের বার মাসের নাম এখনো রয়েই গছে ল্যাটিন ভাষাতেই। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত জার্জিয়ান ক্যালেন্ডারের জন্ম ও ইতালিতে ইউরোপ মহাদেশের প্রধান ভূখণ্ডের দেশগুলোতে আইনী ব্যবস্থার বিকাশে রোমক আইনের অবদান অপরিসীম। এখনো দেশে দেশে রোমান আইন স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। গোথ, হুন ও ভান্ডালদের পৌনঃপুনিক আক্রমণে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

মায়া সভ্যতা :

মেসো শব্দটা গ্রিক। অর্থ, ‘মধ্য’। যেমন, মেসোপটেমিয়া। এর মানে: দুই নদীর মধ্যেখানের অঞ্চল। তেমনি, মেসোআমিরিকায় বলতে বোঝায় মধ্যআমেরিকাকে, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যবর্তী অঞ্চলটিকে (প্রধানত মেক্সিকো) । তো, মেসোআমেরিকায় কতগুলি সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল। যেমন, ওলমেক, অ্যাজটেক, মায়া। এর মধ্যে মায়া সভ্যতার উদ্ভ ও বিকাশ ছিল অভূতপূর্ব। বর্তমান মেক্সিকো, গুয়েতেমালা, বেলিজ ও হন্ডুরাসজুড়ে ছড়িয়ে ছিল মায়া সভ্যতা। লিখিত ভাষাসহ মেসোআমিরিকার সবচে উন্নত সভ্যতা ছিল মায়া সভ্যতা। মায়া সভ্যতা নিয়ে বিস্তর গবেষনা হয়েছে। এখনও চলছে। মায়া সভ্যতার উত্থানকাল ধরা হয় ২৫০ খ্রিস্টাব্দ। নগর সভ্যতা অবশ্য বিকাশ লাভ করেছিল ৯০০ শতক এর দিকে। এবং তা স্পানিশ বিজয় পর্যন্ত বিকাশ লাভ করে চলেছিল। ২৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রথম ৬৫০ বছর মায়ার সভ্যতারক্লাসিক পিরিয়ড ধরা হয়। এই সময়ে মেক্সিকো, গুয়েতেমালা ও উত্তর বেলিজে কমবেশি ৪০টি নগর গড়ে উঠেছিল। বেলিজ দেশটা কারও কারও কাছে নতুন মনে হতে পারে। উন্নতির শীর্ষে মায়া সভ্যতার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০ লক্ষ । বেশির ভাগই বাস করত এখনকার গুয়েতেমালায়। নগরগুলি আসলে ছিল ধর্মীয় কেন্দ্র। বেশির ভাগ মায়া বাস করত নগরের বাইরে –গ্রামে, কৃষিজীবনে।৯০০ শতকের পর গুয়েতেমালার মায়া নগরগুলি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। দক্ষিণের নগরগুলি জনশূন্য হয়ে যায়। ঐতিহাসিকদের মতে যুদ্ধের কারণে বানিজ্যপথের পরিবর্তনই নাকি এর অন্যতম কারণ। তবে মেক্সিকোর ইউকাটন উপদ্বীপের চিচেন ইটজা, উক্সমাল এবং মায়াপান সংস্কৃতির বিকাশ অব্যাহত থাকে ১৫১৯ অবধি। ষোড়শ শতকে যখন মেসোআমেরিকায় স্পেনিশ লুটেরারা এল তখন বেশির ভাগ মায়াই গ্রামীণ কৃষিজীবনে সম্পৃক্ত।

মায়ারা চাষ করত ভূট্টা, বীন ও লাউ। মাংসের মধ্যে খেত টার্কি, তাপির, খরগোশ, বানর ও ম্যাকাও পাখি।স্পেনিয়রা মায়াদের রোমান ক্যাথলিজমে ধর্মান্তরিত করে। মায়ারা আজও আছে। দক্ষিণ মেক্সিাকোয়, গুয়েতেমালায় ও বেলিজে।
মায়ারা আজ রোমান ক্যাথলিজমে বিশ্বাসী হলেও পূর্বেকার মায়া বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, দেবদেবী ও গৃহস্থালী পরব পালন করে আজও। মায়ারা অনেক দেবতায় বিশ্বাসী ছিল। সে দেবতা ভালো কি মন্দ হতেন। ইটজামনা ছিলেন প্রধান দেবতা। তিনি সৃষ্টিকর্তা, আগুন ও উনুনের দেবতা। অন্যএকজন হলেন পালকযুক্ত সরীসৃপ;কুকুলকান। ইনি বৃষ্টি ও বজ্রপাতের দেবতা। মায়াদের উপসনালয়ে এর মূর্তি পাওয়া গেছে। মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাসী ছিল মায়ারা। মৃত্যুর পর আত্মার বিপদজনক ভ্রমন শুরু হত পাতালদেশে। পাতালের অধিকর্তা দেবতা অমঙ্গলকর। সে দেবতার প্রতীক জাগুয়ার। জাগুয়ার রাত্রিরও প্রতীক। স্বর্গে তারাই যাবে যাদের উৎসর্গ করা হয়েছে। আর যারা জন্মের সময়ই মারা গেছে।
গণিত ও জ্যোর্তিশাস্ত্র অভূতপূর্ব উন্নতি করেছিল। অবশ্য সে জ্ঞান অর্জন ছিল ধর্মীয় কৃত্যের সঙ্গে জড়িত । গণিতে শূন্যের ব্যবহার, পজিশনাল নোটেশন নির্ধারণ করেছিল মায়ারা; জ্যোর্তিশাস্ত্রে সৌর বৎসরের গননা, চন্দ্র ও শুক্র গ্রহের অবস্থান এমনকী সূর্যগ্রহনও আগেভাবে বলে দিতে পারত তারা!

মায়ারা প্রকৃতির আবর্তন লক্ষ করেছিল। সময় নিয়ে অবসেসড ছিল। তারা মনে করত বিশ্বজগৎ ৫ বার সৃষ্টি হয়েছে আর ৪ বার ধ্বংস হয়েছে। বছরের কোনও কোনও দিন শুভ কোনও কোনও দিন অশুভ। একসময় ঐতিহাসিকদের ধারনা ছিল মায়ারা শান্তিপ্রিয় । ধর্মনিয়ে মগ্ন থাকে। মায়া হাইয়ারোগ্লাফিক লেখনি পড়তে পারার পর জানা গেল তারা প্রতিদ্বন্দি নগর আক্রমন করত। শাসককে বন্দি করত, টর্চার করত, তারপর তাকে দেবতার কাছে বলি দিত!
নরবলি বা হিউম্যান স্যাক্রিফাইস ছিল মায়াদের ধর্মবিশ্বাসের মূলে।মায়ারা নরবলি দিত উর্বরতা, ধর্মনিষ্টা দেবতার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে । মায়া পুরোহিত বিশ্বাস করত দেবতা মানুষের রক্তে পুষ্ট হন! রক্তই দেবতাদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়।

ইনকা সভ্যতা :

পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর। এরপর আন্দেজ পর্বতমালার পুবমুখি বিস্তার। পেরু নামে একটি দেশ। এই পেরুর পুবেই কুজকো নগর। এসবই আন্দেজ পর্বতমালার মধ্যে। যে আন্দেজ পর্বতমালাটির বিস্তার উত্তর-দক্ষিণে ২,৫০০ মাইল!
সেই কুজকো নগর ঘিরেই সূত্রপাত হয়েছিল কুজকো রাজ্যের (কিংডম অভ কুজকো) যা পরে হয়ে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম পরাক্রমশালী ইনকা সাম্রাজ্য। ইনকা সাম্রাজ্য ছড়িয়ে ছিল পেরু, বলিভিয়া, উত্তর আর্জেন্টিনা, চিলি ও ইকিউডোরে।এত বিশাল সাম্রাজ্য সড়ক পথে যোগাযোগ রক্ষা করত ইনকারা। এই উদ্দেশ্যে ইনকারা নির্মান করেছিল বিস্ময়কর সড়ক; যাকে বলে, ‘ইনকা ট্রেইল’। কৃৎকৌশলের দিক থেকে যা ছিল সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর। মনোরম উপত্যকা ও দুর্গম গিরির ভিতর দিয়ে চলে গেছে ইনকা ট্রেইল। আজও ধ্বংসাবশেষ দেখে চেনা যায়। মূল ২টি পথ ছিল- উত্তর-দক্ষিণে .. কোনও কোনও পথ ১৬০০০ ফুট ওপেের। ৪০, ০০০ কিলোমিটার। সামরিক ও বেসামরিক উভয়শ্রেনির লোকই চলাচল করত। আর চলত লামা ক্যারাভান। সাধারণ লোকের সে পথে চলতে হলে ইনকা সম্রাটের অনুমতি লাগত। পথের মাঝে ছিল সেতু। সেতুতে টোলব্যবস্থা ছিল। ইনকাসাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। সাম্রাজ্যের সময়কাল ১২০০ থেকে ১৫৩৩। ১৫৩৩ সালেই তো স্প্যানিশ লুটেরারা এল ... ইনকা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার নাম মানকো কাপাক। তিনি ও তার বংশধরের সময়েই ইনকা জাতি রচেছিল দক্ষিণ আমেরিকার বিস্ময়কর সভ্যতা। ইনকারা ওদের রাজ্যকে বলত তাহুয়ানতিনসুইউ। মানে চতুস্কোন ভূমি।

ইনকা শাসকরা ছিলেন অভিজাত রাজকীয় বংশের। সম্রাটকে বলা হত ইনকা। পরে অবশ্য সভ্যতার নামই হয়ে যায় ইনকা। সম্রাটের অন্য নাম সাপা ইনকা। সাম্রাজ্য পরিচালনতা করত রাজকীয় পরামর্শসভা। পুরোহিত প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সেনাপতির সমন্বয়েই গড়ে উঠত রাজকীয় পরামর্শসভা। এরা সর্ম্পকে আত্মীয়। সম্রাটগন বিয়ে করতেন আপন বোনকে। পুত্রগনের মধ্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করতেন। সাধারণত বড় ছেলেই সম্রাট হত। ইনকা অভিজাতদেরও কাউন্সিল ছিল। তারা সাম্রাজ্য পরিচালনায় সাহায্য করত। সমস্যা হলে সম্রাট প্রধান পুরোহিত এর যিনি সাধারনত সম্রাটের আত্বীয় ছিলেন। এই চাচা কি ...অন্যকেউ ...যুদ্ধ পরিকল্পনায় সেনাপতিরা। সেনাপতিও বন্ধু কি আত্মীয়ই হত সম্রাটের ।ইনকা যোদ্ধারা অন্য নগর আক্রমন করে জয় করলেও স্থানীয় শাসনকর্তাকে হত্যা করত না যদি সে শাসনকর্তা ইনকা আইন মেনে চলত, বিদ্রোহ না করত, কর দিত আর শষ্য ভান্ডার মজুদ রাখত। ইনকাদের কর ব্যবহা ছিল কঠোর। মেয়েদের নির্দিস্ট পরিমানে কাপড় বুনতে হত। পুরুষেরা কাজ করত সৈন্যবিভাগে কি খনিতে। জনগনও কর দিতে হত। হাতে পয়সা না থাকলে রাষ্ট্রীয় কাজ করে শোধ করে দিত। কিংবা সুতা পোষাক তৈরি করে বিক্রি করে কর দিত। জনগনকে শষ্যের একাংশ রাখতে হত সংরক্ষণের জন্য। খাদ্যশষ্য মজুদের কলাকৌশল রপ্ত করেছিল বলেই ইনকা সভ্যতা নাকি অত উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল-ঐতিহাসিকদের এই মত। সাম্রাজ্যজুড়ে ছিল স্টোরহাউজ। ৩ থেকে ৭ সাত বছরের খাদ্যশষ্য মজুত থাকত সেখানে। মাংসও শুকিয়ে নোনা করে রাখত।

চাষবাস হত উপত্যকায় আর পাহাড়ের ঢালে। ইনকাদের প্রধান খাদ্যই ছিল আলু ও ভূট্টা। আগেই বলেছি আমি মানবসভ্যতায় আলু ইনকাদের অবদান। আলু আর ভুট্টা ছাড়া খেত ওল। নীল শ্যওলাও নাকি খেত । কাঁচা। চাষ করত মরিচ । মাংসের মধ্যে খেত গিনিপিগ ও লামার মাংস। সামুদ্রিক। মাছও খেত। সাম্রাজ্যের পশ্চিমে প্রশান্ত সাগর। আর বিখ্যাত হ্রদ টিটিকাকা। ভূট্টা পিষে এক ধরনের পানীয় তৈরি করে খেত ইনকারা। পানীয়ের নাম: চিচা।
ইনকারা পোশাক তৈরি করত লামার উল দিয়ে। সুতির কাপড়ও পড়ত। অভিজাতরা ধাতুর ঝুলিয়ে রাখত। মেয়েরা একধরনের শাল পরত-নাম মানতাস। নারীপুরুষ উভয়ই পরত স্যান্ডেল।

সাধারন ইনকাদের বাড়িগুলো হত ছোট। সবাই একসঙ্গে থাকত। যৌথপরিবার আর কি। বাড়ি তৈরি করত পাথর ও মাটির ইট দিয়ে ... আর মেশাত ঘাসকাদা। ধনীরা অবশ্য বড়সরো পাথরের সুন্দর প্রাসাদে বাস করত। তাই তো হয়! এরাই ছিল উপত্যকার জমির মালিক। বিয়েটাও ইনকাদের ভারি অদ্ভূত। ২০ বছরের আগেই ছেলেদের মেয়ে চয়েস করতে হত। নইলে তার জন্যই মেয়ে দেখত গার্জেনরা। কোনও কোনও মেয়েকে ছোট থাকতেই বাগদত্তা হতে হত।বিয়ের দিন বর কনের হাত ধরে চন্দন বিনিময় করত। এরপর ভোজ। নতুন দম্পতিকে অন্যরাই ঘরদোর তুলে দেয় । যতক্ষন না তারা নিজের পায়ে না দাড়াচ্ছে ।

বহুদেবতায় বিশ্বাসী ছিল ইনকারা। ভিরাকোকা ছিলেন প্রধান দেবতা। তিনিই ছিলেন ইনকাদের স্রষ্টা। আরেকজন দেবতার নাম ছিল ইনতি। ইনি ছিলেন সূর্যদেব। ইনকাদের বলা হয়: "সূর্যের সন্তান।" ইনকা শব্দটি এসেছে এই ইন্তি শব্দ থেকেই। ইনকারা সূর্যপূজক বলেই উচুঁ পাহাড়ের ওপর তৈরি করত পাথরের মঞ্চ। ইনতিহুয়াটানা। ইন্তি শব্দটা লক্ষ করুন।ইনকারা ছিল ধর্মপ্রাণ। তারা ভাবত যেকোনও মুহূর্তেই অমঙ্গল হতে পারে। কাজেই পুরোহিতদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ন ছিল ইনকা সমাজে। ইনকা সমাজে নারীপুরোহিতও ছিল। মেয়েরা ঋতুমতী হলে নারীপুরোহিতরা
(তথ্যসূত্র-উইকিপিডিয়া)

Post a Comment

Previous Post Next Post