দ্বৈত শাসনব্যবস্থা :
দ্বৈত শাসনের কথা বলতে সাধারণত দুই ধরনের শাসনব্যবস্থাকে বুঝায়। অন্যদিকে, দ্বৈত । | শাসন বলতে প্রশাসনে দু’টি কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি বুঝায়। এছাড়া দ্বৈত শাসনের আলােচনায় Dyarchy শব্দটি এসে যায়।
Dyarchy শব্দটি দু’টি গ্রিক শব্দের যৌগিক। Di শব্দের অর্থ Twice বা দুই এবং Archic শব্দের অর্থ Rule বা শাসন।
এ থেকে বুঝা যায় যে, Dyarchy শব্দের অর্থ দুই সরকার বা দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। দ্বৈত শাসনের মূল কথা হলাে, সরকারের | বিভিন্ন বিষয়সমূহকে দু'ভাগে ভাগ করে শাসন করা। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী এ প্রাদেশিক সরকারের . বিষয়গুলােকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়। যথা : ১. সংরক্ষিত বিষয় (Reserved subject) ও ২. হস্তান্তরিত বিষয় (Transferred subject)। সংরক্ষিত বিষয়সমূহ প্রাদেশিক গভর্নর তার শাসন পরিষদের সহায়তা ও পরামর্শক্রমে শাসন করতেন। সংরক্ষিত বিষয়গুলাে ছিল বিচার, পুলিশ, জল সরবরাহ, অর্থ, কলকারখানা, জলবিদ্যুৎ, সংবাদপত্র, গৃহনির্মাণ, ভূমি রাজস্ব, কৃষি ঋণ ইত্যাদি। অন্যদিকে, হস্তান্তরিত বিষয়সমূহ শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, কৃষি, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন, পূর্ত বিভাগ, সমবায়, আবগারি বিভাগ ইত্যাদি। গভর্নর মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
দ্বৈত শাসনব্যবস্থার কার্যক্রম বা কার্যকারিতা :
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে প্রবর্তিত * দ্বৈত শাসনব্যবস্থা ভারতবর্ষের জনগণের নিকট ছিল একেবারেই একটি নতুন ধরনের শাসনব্যবস্থা। তাছাড়া ভারতের রাজনৈতিক দলগুলাে, বিশেষ করে কংগ্রেসের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হওয়ায় দ্বৈত শাসনব্যবস্থা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে, দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে এ শাসনব্যবস্থার পরীক্ষা নিরীক্ষা চললেও শেষ পর্যন্ত সকল রূপ পরিগ্রহ করতে পারে নি। এইচ রহমান (H. Rahman) 29 160, "Dyarchy was a unique political experiment which was tried in nine provinces for over a period of 16 years."
Ref. (Muddiman Committee Report, P-35)
নিম্নে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে প্রবর্তিত দ্বৈত শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা আলােচনা করা হলাে। |
১, দায়িত্বশীল প্রকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা : দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে হস্তান্তরিত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকারী হয় নি। গভর্নর কর্তৃক মন্ত্রীদের কাজের নগ্ন হস্তক্ষেপই। দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে বাধার সম্মুখীন করেছে। তাছাড়া ভারতের অস্থির ও অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিও। দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। তথাপি একথা অনস্বীকার্য যে, দ্বৈত শাসনব্যবস্থাই ছিল। ভারতের দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ।
২. মন্ত্রী ও শাসন বিভাগের কাউন্সিলরগণের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি ; দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রাদেশিক সরকারের। বিষয়সমূহকে দু'ভাগে ভাগ করার ফলে কাজের পরিধি বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে। ঘােষণা করা হয়, মন্ত্রিগণ ও শাসন বিভাগীয় কাউন্সিলরগণ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে। এর। ফলে মন্ত্রী ও কাউন্সিলরদের দায়িত্ব পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়।
৩. মন্ত্রী ও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে সহযােগিতামূলক সম্পর্ক সৃষ্টি : দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন হওয়ার ফলে। প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীদের সাথে সরকারি কর্মচারীদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে, যা ছিল সহযােগিতামূলক। এর ফলে। প্রাদেশিক পর্যায়ে সরকারি কর্মকাণ্ড সফলতা লাভ করতে থাকে। আর মন্ত্রী ও সরকারি কর্মচারীদের এই সম্পর্ক শুধুই। সহযােগিতামূলক ছিল তা নয় বরং সরকারি কর্মচারীগণ প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণেও সরকারের বিভিন্ন কার্যপদ্ধতি বাস্তবায়নে। সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করতেন।
৪. রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া : দ্বৈত শাসনব্যবস্থাকে সফলভাবে কার্যকর করতে প্রয়ােজন ছিল রাজনৈতিক দলগুলাের পূর্ণ সহযােগিতা। এক্ষেত্রে মধ্যপন্থি রাজনীতিকগণ ন্যাশনাল লিবারেল ফেডারেশন' নামে একটি দল গঠন। করে। এ নবগঠিত রাজনৈতিক দল ১৯২০ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় এবং অধিকাংশ প্রদেশে তারা মন্ত্রিসভা গঠন। করেন। কিন্তু তাদের এ উদ্দেশ্য সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি কারণ কংগ্রেস দ্বৈতশাসনের বিপক্ষে ছিল।
ক্ষত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা : দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অধীনে কেন্দ্র ও প্রদেশের জন্য আয়ের উৎসসমূহকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। যেমন- আয়কর ও বাণিজ্য শুল্ক কেন্দ্রের জন্য এবং ভূমি রাজস্ব ও মাদকদ্রব্যের উপর আবগারি শুল্ক প্রভৃতি প্রদেশের জন্য নির্ধারিত ছিল। এর ফলে কেন্দ্র ও প্রদেশের আয়ের সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬. মুডিম্যান কমিটির অভিমত : দ্বৈত শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা সম্পর্কে মুডিম্যান কমিটি যে রিপাের্ট প্রদান করে
তাতে উল্লেখ করা হয় যে, দ্বৈত শাসনব্যবস্থা আইন পরিষদের সদস্যবর্গ, নির্বাচনমণ্ডলী ও মন্ত্রীদের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় | রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণের সুযােগ সৃষ্টি হয়। তবে রিপাের্টে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা স্বীকার করে বলা হয় বাংলা ও উত্তর প্রদেশে মূলত এ ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে নি।
৭. বিহার সরকারের মত : দ্বৈত শাসনব্যবস্থা খুবই ধীরগতিতে চলছিল বলে অভিমত দেন বিহার প্রদেশের তৎকালীন সরকার। ঐ ধীরগতির কারণেও দ্বৈতশাসন যথার্থরূপে কার্যকরী হতে পারে নি।
উপসংহার : উপযুক্ত আলােচনা শেষে বলা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায় বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ভারতের সাংবিধানিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। আইন পরিষদের পরিধি বৃদ্ধি এবং গণতন্ত্রায়নের সুযােগ সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং সময়, পরিবেশ ও পরিস্থিতির। কারণে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা সফল না হলেও পরবর্তী ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিকাশ ধারায় এর যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
0 Comments