Hot Posts

6/recent/ticker-posts

বাংলাদেশের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহ আলোচনা কর

The Fundamental Rights Stated in the Constitution of 1972

মৌলিক অধিকার বলতে মানবজীবনের এমন কতকগুলাে অপরিহার্য সুযােগ সুবিধাকে বুঝায়, যেগুলোর সদ্ব্যবহার দ্বারা কোন ব্যক্তি স্বীয় বিকাশের পথ খুজে পায় এবং মানবজীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারে। সংবিধানের সংশােধন কিবা দেশে জরুরি অবস্থা জারি ছাড়া মৌলিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করা যায় না। মৌলিক অধিকারগুলাের পিছনে সমাজ বা রাষ্ট্রীয় কতৃত্বের নিশ্চয়তা থাকে।

আরো পড়ুন বাংলাদেশ সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের গুরুত্ব ।

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত করেছে। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ভারত প্রভৃতি রাষ্ট্র। বাংলাদেশের সংবিধানও এর ব্যতিক্রম নয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানকেও বেশ কিছু মোলিক অধিকার নিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৭ নং অনুচ্ছেদ থেকে ৪৭(ক) নং অনুচ্ছেদ পর্যন্ত মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারসমূহ নিম্নরূপঃ
১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহ।

১। আইনের চোখে সমতাঃ সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং সকলেই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি বিশেষ সুবিধা দাবি করতে পারে না। সকল ব্যক্তি আইন দ্বারা সমভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং কেহ আইনের উর্ধ্বে নয়। (অনু-২৭)।

২। ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্যহীনতাঃ ধর্ম, বর্ণ, গােষ্ঠী, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি এই বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। জনগণের কোন বিনােদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না। তবে রাষ্ট্র নারী, শিশু বা অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারবে। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে। (অনু-২৮)।

৩। সরকারি নিয়ােগ লাভে সুযােগের সমতাঃ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়ােগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। ধর্ম, গােষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে নাগরিকদের প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়ােগের সুযোগের সমতার ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। (অনু-২৯)।

৪। উপাধি, সম্মান ও ভূষণের বিলােপসাধনঃ রাষ্ট্র কোন উপাধি, সম্মান বা ভূষণ প্রদান করবে না। রাষ্ট্রপতির পূর্ব অনুমােদন ব্যতীত কোন নাগরিক বিদেশী রাষ্ট্রের নিকট থেকে কোন উপাধি, সম্মান বা ভূষণ গ্রহণ করবে না। তবে সাহসিকতার জন্য পুরস্কার বা একাডেমিক পুরস্কার গ্রহণের ক্ষেত্রে তা প্রযােজ্য হবে না। (অনু-৩০)

মৌলিক অধিকার

৫। জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারঃ

ক, বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল ব্যক্তি কেবল আইনানুসারে নিয়ন্ত্রিত হবে এবং আইনানুযায়ী ব্যতীত কারও জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি করা যাবে না। (অনু-৩১)।

২. আবার আইনানুগ ব্যবস্থা ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না। (অনু- ৩২)

৩১ ও ৩২ এ দুই অনুচ্ছেদে আইনের প্রাধান্য স্বীকার করা হয়েছে। আইনের অনুমােদন ব্যতীত শাসন কর্তৃপক্ষ বিচারমূলকভাবে কারও জীবন, সম্পত্তি বা স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

৬। গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচঃ কোন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ না জানিয়ে আটক রাখা যাবে না। কোন ব্যক্তিকে তার মনােনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শ ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না। গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হবে এবং আদালতের আদেশ ব্যতীত তাকে উক্ত সময়ের অধিককাল আটক রাখা যাবে না। তবে কোন বিদেশী শক্রর ক্ষেত্রে উপরোক্ত কোন কিছুই প্রযােজ্য হবে না। (অনু-৩৩)

৭। জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ ঃ সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ এবং এ কোনভাবে লঙ্গিত হলে তা আইনত দন্ডনীয় বলে গণ্য হবে। তবে ফৌজদারি অপরাধের জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযােজ্য হবে না। (অনু-৩৪)

৮। অপরাধের দণ্ডবিধান ঃ সংবিধানের ৩৫ নং অনুচ্ছেদে অপরাধের দণ্ডবিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে যে-

(ক) যে সময়ে কোন কার্য সংঘটিত হয়েছে সেই সময়ে প্রচলিত আইনের বিধান লঙ্ঘন করা না হলে ঐ কার্যের জন্য কাকেও দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না এবং সেই সময় প্রচলিত আইনে কোন অপরাধের জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত ছিল তার অধিক দণ্ড দেয়া চলবে না। (অনু-৩৫ (১))

(খ) এক অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তিকে একাধিকবার অভিযুক্ত বা দণ্ডিত করা যাবে না। (অনু-৩৫ (২)]

(গ) ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী। [অনু-৩৫ (৩)]

(ঘ) কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কোন ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে বাধ্য করা যাবে না। (অনু-৩৫ (৪)]

(ঙ) কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর ও অমানুষিক দণ্ড দেয়া যাবে না। (অনু-৩৫ (৫)]

৯। স্বাধীনতার অধিকারঃ ৩৬ হতে ৪১ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত অধিকারগুলােকে স্বাধীনতার অধিকার বলা যেতে পারে। এ অধিকারগুলাের মধ্যে রয়েছে চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা, পেশার স্বাধীনতা ও ধর্মের স্বাধীনতা। এগুলাে নিম্নরূপঃ

(ক) চলাফেরার স্বাধীনতাঃ সকল নাগরিক বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধে চলাফেরা করতে পারবে, যে কোন স্থানে বসবাস করতে পারবে এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও এ দেশে পুনঃপ্রবেশ করতে পারবে। তবে জনস্বার্থে আইনের দ্বারা এ স্বাধীনতার উপর যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ আরােপ করা যাবে। (অনু-৩৬)

(খ) সমাবেশের স্বাধীনতা ও জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরােপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হবার এবং জনসভা ও শােভাযাত্রায় যােগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। (অনু-৩৭)

(গ) সংগঠনের স্বাধীনতা ও জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরােপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে সমিতি বা সংগঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে কোন সংগঠন করা যাবে না। (অনু-৩৮)

(ঘ) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতাঃ সকলের চিন্তা ও বিবেকের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। বাক স্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররােচনা সম্পর্কে রাষ্ট্র আইনের দ্বারা যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ আরােপ করতে পারবে। (অনু-৩৯) ,

(ঙ) পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতাঃ যােগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিক আইনের দ্বারা আরােপিত বাধানিষেধসাপেক্ষে যে কোন আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণ করতে এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারবে। (অনু ৪০)

(চ) ধর্মীয় স্বাধীনতাঃ আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতাসাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে এবং প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যােগদানকারী কোন ছাত্রকে নিজস্ব ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হবে না। (অনু-৪১)

১০। সম্পত্তির অধিকারঃ আইনের দ্বারা আরােপিত বাধানিষেধসাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিক সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিধিব্যবস্থা করতে পারবে। আইনের নির্দেশ ব্যতীত কোন নাগরিককে সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করা যাবে না। (অনু-৪২)

১১। গৃহে নিরাপত্তা ও গােপনীয়তার অধিকারঃ প্রত্যেক নাগরিক স্বীয় ঘরে নিরাপত্তা লাভ করবে অর্থাৎ বলপূর্বক কারো গৃহে প্রবেশ করা, তল্লাশী করা এবং কাকেও আটক করা যাবে না। তাছাড়া প্রত্যেক নাগরিক তাদের চিঠিপত্রের বা যোগাযােগের (রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিরােধী নয়) অধিকার লাভ করবে। (অনু-৪৩)।

১২। সাংবিধানিক প্রতিকারের অধিকারঃ সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারসমূহের পরিপন্থী কার্যাবলির প্রতিকারের বিধান সংবিধানে দেয়া হয়েছে। কোন নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ হলে তিনি সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে অথবা ক্ষমতাপ্রাপ্ত যে কোন আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাষ্ট্র মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করবে না। এরূপ আইনের অসামঞ্জস্য অংশ বাতিল বলে গণ্য হবে। মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ পূর্ণ কোন আইনকে আদালত প্রয়ােগ করবে না। (অনু-৪৪)

১৩। দায়মুক্তি বিধানের ক্ষমতাঃ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি বা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে কিছু করে থাকলে, জাতীয় সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করতে পারবে। (অনু-৪৬)।

সবশেষে বলা যায় যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারগুলাে বর্ণিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের জনগণ তার অধিকার ভােগের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা পায় এবং কর্তব্য পালনে সচেতন হয়। এতে সরকারও স্বৈরাচারী হতে পারে না ১৯৭৭ সালের সংবিধান (সংশােধন) আদেশ অনুযায়ী মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এ আদেশে সম্পত্তি রাষ্টায়ত্তকরণ ও সম্পত্তি দখলের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
#মৌলিক অধিকার #মৌলিক অধিকার

Post a Comment

0 Comments