বাংলাদেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান এবং ক্রমেই এখানে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের এ সংখ্যা বৃদ্ধির পশ্চাতে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এগুলাে নিম্নরূপঃ
বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক দল থাকার কারণঃ
১, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা : বাংলাদেশে যেহেতু মূলত পুজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা বিরাজমান কাজেই এখানে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার ব্যবধান রয়েছে অনেক। আর এ ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলছে। দেশের সমুদয় সম্পদ গুটিকয়েক ব্যক্তি পরিবারের হাতে কুক্ষিগত। এরাই হচ্ছেন দেশের রাজনীতির চালিকাশক্তি (Moving force)। রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই আবার উক্ত ক্ষমতার সুবাদে নিজেদের জন্য অর্থনৈতিক সুযােগ সুবিধা লাভ করতে ব্যস্ত। পক্ষান্তরে, যাদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই তারা তা লাভের জন্য সদা সচেষ্ট থাকেন। এ ক্ষমতা লাভের সহজ উপায় হিসেবে তারা দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে অগ্রসর হয়। আর সে উদ্দেশ্যে তারা রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২। জাতীয় আদর্শের অনৈক্যঃ বাংলাদেশে অনুন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপস্থিতির কারণে জাতীয় আদর্শের ক্ষেত্রে গণমানুষের মধ্যে জাতীয় আদর্শের বিষয়ে অনৈক্য দেখা যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয় সংহতির বিষয়টি অনেকটাই অপরিচিত । রাজনৈতিক এলিটগণও জাতীয় আদর্শের বিষয়ে মতানৈক্য ভােগে; যেমন : রাষ্ট্রীয় মৌল নীতি, সরকারের প্রকৃতি, অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি বিষয়ে মতানৈক্য অনেক রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের অন্যতম একটি কারণ।
৩। জাতীয় নীতিমালার অনৈক্যঃ সুষ্ঠ দলীয় ব্যবস্থা, কোন্দলবিহীন কার্যকর রাজনীতি সুশৃঙ্খল দলীয় ব্যবস্থার জন্য জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সময় পরও এ বিষয়গুলাে সম্পর্কে ঐকমত্যের অভাব বহু রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্ম দিয়েছে। ফলে এ দেশে বহু রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
৪। আদর্শ ও কৌশলগত পার্থক্য : জাতীয় আদর্শ ও নীতিমালার ব্যাপারে অনৈক্য অনেক রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্ম দেয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক এলিট ও জনগণের মধ্যে জাতীয় আদর্শ ও নীতিমালার ব্যাপারে অনৈক্য অনেক বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া, যেসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে সেসব উদ্দেশ্য সাধনের কৌশল নিয়ে দলের মধ্যে মতানৈক্য থাকে। এ বিরােধ এলিটদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও ফাটল সৃষ্টি করে। ফলে রাজনৈতিক দলের ভাঙ্গন দেখা যায় ও নতুন দলের উদ্ভব ঘটে। ধর্মভিত্তিক ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে ধর্মীয় শাসন ও সমাজতন্ত্র কায়েমের পন্থা নিয়ে অনৈক্য অনেক বামপন্থী রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছে।
৫। ক্ষমতার লােভঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলােতে নেতৃবৃন্দের মধ্যে পদ ও ক্ষমতার লােভ প্রকট- যা পারস্পরিক প্রতিযােগিতার জন্ম দেয়। এভাবে পদ ও ক্ষমতার লােভ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। অনেক সময় ক্ষমতা প্রত্যাশী নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযােগ উত্থাপন করেন ও দল ত্যাগ করেন এবং নতুন দল গঠন করেন; যেমনঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ (আওয়ামী লীগ মালেক, আওয়ামী লীগ মিজান ও বাকশাল) এবং - রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপিতে (আবদুল মতিন ও শামছুল হক এবং দুদু-নিলু) ঘটেছে।
৬। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চরিত্রঃ রাজনৈতিক দলের সুষ্ঠ ভিত্তি ও কার্যকারিতা এর নেতৃবৃন্দের গুণাবলি ও চারিত্রিক বশিষ্ট্য ও দৃঢ়তার উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। কাজেই নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত হতে হয়। কিন্তু আমাদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে এসব গুণের দারুণ অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা প্রায়ই বিদেশী ভাবধারা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বদেশের স্বার্থ ভুলে গিয়ে কেবল নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট হন। ক্ষমতার মােহে আচ্ছন্ন হয়ে তারা দেশের আপামর জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। দলের অন্যান্য নেতা ও কর্মীদের কথায় তারা কর্ণপাত করেন না। ফলে তারা নিজেদের অবহেলিতবােধ করেন এবং নিজেদের রাজনৈতিক জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নতুন দল গঠন করেন। দেশের সবগুলাে রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই এটা সমভাবে প্রযােজ্য।
৭। অভ্যন্তরীণ দলীয় মতানৈক্য ও কোন্দলঃ বাংলাদেশে এত অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দল থাকার অপর এক উল্লেখযােগ্য কারণ হলাে দলগুলাের অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য ও কোন্দল। এ অভ্যন্তরীণ দলীয় মতানৈক্য ও কোন্দলের পশ্চাতে আবার কাজ করছে কতিপয় উপাদান, যেমন : রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্ষমতার লােভ, রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ভাঙ্গন, রাষ্ট্রীয় মৌলনীতির ক্ষেত্রে ঐকমত্যের অভাব প্রভৃতি। এর অশুভ প্রভাব পড়ছে দেশের রাজনীতির উপর। এ কারণে বর্তমানে রাতারাতি দল ভাঙ্গছে আর গড়ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে এ ভাঙ্গাগড়ার নিরন্তর খেলা। ফলে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। '
৮। রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপঃ এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এর কোন ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দু’ দু’বার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। ফলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলাে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে। সামরিক বাহিনী ও সামরিক আমলাতন্ত্রই রাজনীতির নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বিপরীতে রাজনৈতিক দলগুলাে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। সামরিক শক্তির প্রভাবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলাে ভেঙ্গে বিভিন্ন উপদলে পরিণত হচ্ছে।
৯। সহনশীলতার অভাবঃ বাংলাদেশে দলীয় নেতাদের মধ্যে সহনশীলতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। সহনশীলতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। এর অভাবে বাংলাদেশে আজও সত্যিকার গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। প্রত্যেক দলীয় নেতা তার নিজস্ব মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এর ব্যতিক্রম ঘটলে দেখা দেয় দলত্যাগের পাঁয়তারা। ক্রমে গড়ে উঠে নতুন নতুন দল। আমাদের দেশে কোন ব্যক্তি দল ত্যাগ করলে বা দল থেকে বহিষ্কৃত হলে তার রাজনৈতিক জীবনের কোনরূপ ক্ষতি বা অবসান ঘটে না। কাজেই রাজনীতিবিদদের মনে দল ত্যাগের প্রবণতা থেকেই যায় এবং ফলে বহু দলের উদ্ভব ঘটে।
১০। ব্যাপক দারিদ্র্য ও গণচেতনার অভাবঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণই গরিব। এর ফলে প্রায়ই রাজনৈতিক অসন্তোষ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল এ দারিদ্র্যকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল গঠন করে তাদের স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট হয়। জনগণের মধ্যে গণচেতনার অভাবের কারণেই কেবল এটা সম্ভব হচ্ছে। অধিকাংশ জনগণই সু শিক্ষায় অশিক্ষিত বিধায় এ সুযােগে স্বার্থান্বেষী মহল নতুন দল গঠন করে সহজেই তাদের পক্ষে গণসমর্থন আদায় করে নেয়।
১১। বিদেশী শক্তির প্রভাবঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােতে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব অধিকমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের এ প্রভাব পরােক্ষভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােতে রাজনৈতিক দলগুলাের মাধ্যমে ঘটান হয়ে থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানে বিদেশী শক্তি দেশের রাজনৈতিক দলগুলাের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে অর্থের প্রলােভন দেখিয়ে তাদের উপর বিভিন্নভাবে প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করে। এর স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে দলত্যাগ ও নতুন দল গঠনের পালা। .
১২। অসহিষ্ণুতা ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বঃ আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে পরমত সহিষ্ণতার অভাব লক্ষণীয়। অনেক সময় শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বা সিদ্ধান্তগ্রহণের সময় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা বিরােধের জন্ম দেয়। পরস্পরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবােধ থাকে না। এর ফলে নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় ও দলে ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
১৩। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাবঃ সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠলেও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নীতি ও আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পডে; যেমন ঃ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাপা। ফলে ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাবে নীতি ও আদর্শের প্রতি আনুগত্যের অভাব অনেক সময় দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে।
১৪। সামাজিকীকরণের সমস্যাঃ বাংলাদেশে সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলাে দুর্বল, অসংগঠিত ও সুসমন্বিত নয় । জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলার মতাে পর্যাপ্ত কর্মসূচি অনুসৃত হয় না। রাজনৈতিক দলের অন্যতম কাজ হলাে অনুসারীদের দলীয় ও রাষ্ট্রীয় নীতি-আদর্শ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিতকরণ। কিন্তু অধিকাংশ দল এ ব্যাপারে সক্রিয় বা নিস্পৃিহ নয়। ফলে রাজনৈতিক দীক্ষার অভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শে ব্যাপক বিভক্তি এবং দলীয় কোন্দল, বিভাজন, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, সহনশীলতার অভাব ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয় ও দলে ভাঙ্গন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে।
১৫। সুবিধাবাদ ও স্বার্থতা ঃ যেহেতু একটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন স্বার্থ গােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, সুবিধাবাদী শ্রেণি নিজেদের স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়। অনেক নেতাকর্মী দল ও দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু নিজেদের স্বার্থ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে এসব গােষ্ঠী দল ত্যাগ করে নতুন দল গঠন করে।
0 Comments