সাধারণভাৰে সংস্কৃতি বলতে বুঝায় মার্জিত রুচি বা অভ্যসজাত উৎকর্ষ। সহজভাবে বলা যায়, সংস্কৃতি হলাে শিক্ষা ও চর্চার দ্বারা পরিশীলিত এবং মার্জিত রুচিসম্পন্ন আচার অনুষ্ঠান।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : নিম্নে সংস্কৃতির কতিপয় সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলাে :
এডওয়ার্ল্ড টেইলার এর মতে, “সমাজের সমষ্টিগত জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নৈতিকতা, রীতিনীতি, আইন, মানুষের অর্জিত বিভিন্ন অভ্যাস ও দক্ষতা সবকিছুরই জটিল মিশ্র রূপ হলো সংস্কৃতি।”
Malinowski এর মতে “সংস্কৃতি হলাে মানুষের তৈরি বস্তু এবং একটি উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য সাধন করে।”
Jones এর মতে, Culture is the sumtotal of mans creation" অর্থাৎ, মানব সৃষ্ট সকল কিছুরই সমষ্টিই হলাে সংস্কৃতি।
ম্যাকাইভার এর মতে, "Our culture is what we are," অর্থাৎ, আমরা যে অবস্থায় আছি, তাই সংস্কৃতি।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব বা প্রয়ােজনীয়তা : নিম্নে রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব বা প্রয়ােজনীয়তা আলােচনা করা হলাে :
১, পরিবর্তন ব্যাখ্যা : প্রতিটি সমাজ ও সংস্কৃতিই পরিবর্তনশীল। সমাজ ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষের সমাজ জীবন ও আচরণেও পরিবর্তন আসে। মানুষ নতুনত্বের ধারায় আলােড়িত হয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি সমাজ ও সংস্কৃতি পরিবর্তন সংক্রান্ত যাবতীয় অধ্যয়নে অংশগ্রহণ করে। এতে পরিবর্তনের ধারা, ফলাফল, কারণ, সময়, উদ্দেশ্য প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলােচনা করে। অতীত ঐতিহ্য ও ধর্ম প্রক্রিয়া পরিবর্তিত হয়ে কিভাবে বর্তমান রূপ লাভ করে। অর্থাৎ অতীত থেকে বর্তমান পেয়েছে, সে বিষয়ে এ তথ্য প্রদান করে। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সর্ব উন্নয়নকে স্বরান্বিত করতে পারে না।
২. রাজনৈতিক ব্যাখ্যা প্রদান : প্রত্যেক দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্লেষণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি 'রুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে বজনীতির কতিপয় বিষয়ে সংশ্লিষ্টতা, সেগুলাে মানব আচরণ ও মনোভাবের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ ধরনের সম্পর্ক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিশ্লেষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৩, বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণ ঘটানাে ; রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেসব উপাদানে সমন্বয়ে গঠিত হয় সেগুলো ব্যষ্টিক ও শটির মধ্যকার যােগসূত্র স্থাপনে সহায়ক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যক্তির আচরণ ও মনােভাব উপসংস্কৃতিসহ বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত হয়। তাছাড়া রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আদা পাথক্য নিরূপণ করে। এভাবে মুল কাজনৈতিক ধারায় প্রবাহিত হয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করে সাথে সাথে সংস্কৃতিকেও সমুন্নত রাখে।
৪,. জাতীয় সংহতি অর্জন : রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব হিসেবে বলা যায় রাজনৈতিক সংস্কৃতি জাতীয় সংহতি বা একাত্মতা সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।
৫. গােষ্ঠী ও উপগােষ্ঠী সম্পর্কিত আলােচনাঃ সংস্কৃতি যেমন সংকীর্ণ বিষয় নয়, তেমনি একই সাথে রাজনীতিও এলট বিস্তৃত বিষয়। একই রাজনীতি ও সংস্কৃতির অন্তর্গত বিভিনুগােষ্ঠী উপগােষ্ঠীকে নিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আলােচনা করে। বিভিন্ন উপগােষ্ঠীর সংস্কৃতি আলােচনা করতে গিয়ে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক গােষ্ঠী ও উপগােষ্ঠীর মধ্যকার পার্থক্য নিরূপণ করে। এভাবে গােষ্ঠীর তুলনায় উপযোগীর বিভিন্ন সমস্যা এবং প্রত্যাশা সম্পর্কে জানা সহজ হয়।
৬, জাতি গঠন ও জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা : আধুনিক বিশ্বে কিছু কিছু বৃহৎ রাষ্ট্র ভেঙে জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আবার কিছু কিছু রাষ্ট্রের অখণ্ডতা বিপন্ন হয়েছে। জাতি গঠন ও জাতীয় রাষ্টের প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে এদের অখণ্ডতা বিপন্ন হতে পারে। জাতি গঠন ও জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মতাে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রসঙ্গে Myron Weiner বলেছেন, “যেখানে (ভারত) কেবল এলিট ও Mass সংস্কৃতি নয়, বরং বিভিন্নমুখী Mass সংস্কৃতি পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত, যা জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করেছে।" জাতি গঠনের বিষয়টি উন্নয়নশীল দেশগুলােতে বেশি প্রয়ােগ করা যায় । উন্নয়নশীল দেশে একই জাতি ও জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা গেলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
৭, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ; একটি দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সর্বতােভাবে রাষ্ট্রের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে। সরকার, রাজনীতি, রাজনৈতিক দলের কার্যপ্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক গতিতে প্রবাহিত করার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা অপরিহার্য। রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে সহায়তা করে।
৮, রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ : রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের সাথে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। ব্যক্তিকে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার পারিপার্শ্বিকতার সাথে পরিচিত করে দেয়া হয়। সামাজিকীকরণের বিশেষ পর্যায়ে মানুষ সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা রাজনৈতিক কৃষ্টি ব্যক্তিকে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের আওতায় আনতে সহায়তা করে।
৯. ভবিষ্যদ্বাণী : যে কোন তত্ত্ব বা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা একটি বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যক্তির সাথে রাজনীতির সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতির বর্তমান ও অতীত বিশ্লেষণ করে এবং বর্তমান ও অতীত অবস্থার প্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎকে বিশ্লেষণ করতে পারে। এভাবেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করতে পারে।
১০. রাজনৈতিক কাঠামোর বিশ্লেষণ : Sidney Verba বলেছেন, “রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও কাঠামাের মধ্যে সম্পর্কের চক্র বিদ্যমান"। একটি সমাঙ্গে রাজনৈতিক কাঠামাে জনগণের মনােভাব ও আচরণের অনুশীলনের মাধ্যমে গড়ে উঠে। জনগণের মনােভাব ও আচরণ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠে। সামাজিকীকরণে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষ বিশেষ সংস্কৃতির সাথে পরিচিতি লাভ করে। এ সংস্কৃতিই বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে তােলে।
উপসংহার : উপযুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি মূলত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তির মনােভাব ও মূল্যবােধ, যা আধুনিক রাজনীতি বিশ্লেষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর এ রাজনৈতিক সংস্কৃতির গঠন, সংরক্ষণ ও সঞ্চালনের প্রক্রিয়াই হলাে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ। তাই পরিশেষে বলতে হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে কোন দেশের Political situation পরিবর্তন সামাজিকীকরণ ঘটানাে ব্যক্তি আচার আচরণকে প্রভাবিত ও পরিবর্তন করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেই চলেছে।
0 Comments