Hot Posts

6/recent/ticker-posts

আফগানিস্তান রাশিয়া যুদ্ধ পরবর্তী তালেবানের ধ্বংসযজ্ঞ ও মার্কিন সেনাদের দুই দশক



বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে আফগানদের যুদ্ধের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। আফগানিস্তানের প্রাগৈতিহাসিক ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস জানান দেয় দেশটির রোমাঞ্চকর ও সাহসিকতার কথা। প্রথমে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শক্তি, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির সঙ্গে বরাবরই লড়াই করে গেছে আফগানরা। বিশ্বের সব পরাশক্তির সঙ্গে তালেবান গোষ্ঠীর লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি ধ্বংসপ্রায়।

হাজার বছরের সংকটে আফগান।



আফগানিস্তানের ইতিহাস-ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতাত্তিক স্থান খনন করে দেখা গেছে, দেশটির উত্তর অংশ অর্থাৎ আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে মনুষ্য বসতি ছিল। ধারণা করা হয়, আফগানিস্তানের কৃষি খামার বিশ্বের প্রাচীন খামারগুলোর একটি। আফগানিস্তানের ইতিহাসে বহু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- গ্রেকো-বারট্রিয়ান, কুশান, হেফথালিটিস, কাবুল শাহী, সাফারি, সামানি, গজনবী, ঘুরি, খিলজি, কারতি, মুঘল ও সবশেষে হুতাক ও দুররানি সাম্রাজ্য। দেশটির ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রাক ইসলামী শাসনামলের পূর্বে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের পর মধ্য এশিয়া থেকে এখানে লোক আসতে শুরু করে। যারা অধিকাংশ ছিল আর্য, যারা ইরান ও ভারতেও বসতি স্থাপন করেছিল। তখন এলাকাটির নাম ছিল আরিয়ানা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পারস্য সাম্রাজ্য প্রাচীন আরিয়ানা দখল করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে মহামতি আলেকজান্ডার পারস্যের সম্রাটকে পরাজিত করে অঞ্চলটির পূর্ব সীমান্ত দখল করে নিতে সক্ষম হন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালের পর অর্থাৎ আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর অনেক রাজ্য তার এশীয় সাম্রাজ্যের দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। এদের মধ্যে সেলুজিত সাম্রাজ্য, বাকত্রিয়া সাম্রাজ্য ও ভারতীয় মৌর্য সাম্রাজ্য উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে মধ্য এশীয় কুশান জাতি আরিয়ানা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় থেকে অষ্টম শতাব্দী বৌদ্ধ ছিল এখানকার প্রধান ধর্ম। এরপর হুন নামের মধ্য এশীয় এক তুর্কি জাতি চতুর্থ শতাব্দীতে এসে কুশানদের পতন ঘটায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে আরব সৈন্যরা আফগানিস্তানে নতুন ধর্ম ইসলাম নিয়ে আসে। পশ্চিমের হেরাত ও সিস্তান প্রদেশ আরবদের নিয়ন্ত্রণে আসে কিন্তু আরব সৈন্য চলে যাওয়া মাত্রই সেখানকার জনগণ তাদের পুরনো ধর্মে ফেরত যায়। দশম শতাব্দীতে বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারা থেকে সামানিদ নামের মুসলিম শাসক বংশ আফগান এলাকায় প্রভাব বিস্তার শুরু করে। তখন থেকে গজনীতে গজনবী রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯৯৮ থেকে ১০৩০ সাল পর্যন্দ গজনীর রাজা মাহমুদ গজনবী আফগান শাসন করেন। রাজা মাহমুদ গজনবীর মৃত্যুর পর গজনীর প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। ১২শ শতাব্দীতে পশ্চিম-মধ্য আফগানিস্তানের ঘুর শহরে ঘুরি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা আবার ১২১৫ সালে মধ্য এশিয়ার খোয়ারিজমি শাহদের কাছে পরাজিত হন। ১২১৯ সালে চেঙ্গিস খান খোয়ারিজমি শহর হেতাত ও বালখ এবং বামিয়ানে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। ১৪শ শতাব্দীর শেষে মধ্য এশীয় সেনাপতি তৈমুর লং আফগানিস্তান জয় করেন ও ভারতে অগ্রসর হন। যদিও তৈমুরের সন্তান ও পৌত্রেরা তার সাম্রাজ্যর পুরোটা ধরে রাখতে পারেনি। ১৬শ শতাব্দীর শুরুতে ১৫০৪ সালে তৈমুর লং-এর বংশধর জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবর আরঘুন রাজবংশের নিকট থেকে কাবুল দখল করেন। তারপর ১৫২৬ সালে তিনি ভারতে গিয়ে দিল্লি সালতানাতে আক্রমণ চালিয়ে লোদি রাজবংশকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। ১৬শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর পুরোটাজুড়ে ভারতে অবস্থিত মুঘল সাম্রাজ্য, উজবেক বুখারা খানাত এবং পারস্যের সাফাভি রাজবংশের রাজারা আফগানিস্তানের দখল নিয়ে যুদ্ধ করেন। ১৭০৯ সালে স্থানীয় ঝিলজাই গোত্রের নেতা মিরওয়াইস হুতাক সাফাভিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং গুরগিন খানকে পরাজিত করে স্বাধীন আফগানিস্তান স্থাপন করেন। মিরওয়াইস ১৭১৫ সালে মারা যান এবং তার স্থলে তার ভাই আবদুল আজিজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। মিরওয়াইসের পুত্র মাহমুদ হুতাক তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য হত্যা করে। মাহমুদ ১৭২২ সালে পারস্যের রাজধানী ইস্পাহানে আক্রমণ চালান এবং গুলনাবাদের যুদ্ধের পর নগরীটি দখল করে নিজেকে পারস্যের রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। ১৭৪৭ সালে আহমদ শাহ দুররানি কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে এখানে দুররানি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। ১৭৭২ সালে দুররানির মৃত্যু হয়। তার পুত্র তৈমুর শাহ দুররানি তার স্থলাভিষিক্ত হন। এই সময় থেকে আফগানিস্তান প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে অনেক অঞ্চল হারাতে শুরু করে। ১৭৯৩ সালে তৈমুরের মৃত্যুর পর তার পুত্র জামান শাহ দুররানি ক্ষমতায় আসেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে মাহমুদ শাহ দুররানি, সুজা শাহ ও অন্যরা সিংহাসনে আরোহণ করেন।



রাশিয়া ও আফগানিস্তানের দীর্ঘ যুদ্ধ

১৯৭৮ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খানের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন বামপন্থি সামরিক কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ তারাকির বাহিনী। এরপর ক্ষমতা ভাগাভাগি হয় মার্ক্স ও লেনিনপন্থি দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে। পিপলস পার্টি ও ব্যানার পার্টি একসঙ্গে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে আবিভর্‚ত হয়। ওই সরকারের জনপ্রিয়তা না থাকলেও মাথার ওপর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আশীর্বাদ। বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতি ও শহুরে গোষ্ঠীগুলো নতুন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে, যাদের বলা হয় মুজাহিদিন। তখন সরকারের মধ্যকার পিপলস ও ব্যানারের দুটি অংশের দ্ব›েদ্বর মধ্যে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে ৩০ হাজার সেনা নিয়ে প্রবেশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। অল্প সময়ে ক্ষমতাচ্যুত হন পিপলস নেতা হাফিজুল্লাহ আমিন। ক্ষমতায় বসেন ব্যানার নেতা বাবরাক কারমাল। কিন্তু তিনিও জনপ্রিয় হতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মুজাহিদিনরা। ওই সময় মুজাহিদিনদের প্রতি পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম দেশগুলো সহানুভূতিশীল ছিল। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে এবং সে দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।



তালেবানের উত্থান, চালায় ধ্বংসযজ্ঞ

১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিক। আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষা করতে সে দেশে ঢুকে পড়ল সোভিয়েত সেনাবাহিনী। মস্কো তখন বলেছিল, সোভিয়েত সৈন্যরা ছয় মাস থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে দেশে সোভিয়েত সৈন্যরা ছিল দীর্ঘ ১০ বছর এবং আফগানিস্তান পরিণত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনামে। সে যুদ্ধের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল তার বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠল আফগানিস্তান। আফগানিস্তানের সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভিতর দিয়েই জন্ম হয়েছিল তালেবান এবং আল-কায়েদার মতো জিহাদি বাহিনীগুলোর। তখন থেকে আফগানিস্তানে সশস্ত্র সংগঠনগুলো ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমে উঠেপড়ে লাগে। সে সময় তারা নৃশংস ধর্মান্ধতা চাপিয়ে আফগানিস্তানকে পেছনের যুগে ঠেলে দেয়। তখন ওই মুজাহিদিন তথা তালেবান যোদ্ধারা ইসলামী শাসনের নামে মহিলাদের বাড়িতে আটকে রাখে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। আপদমস্তক বোরকা পরতে বাধ্য করে এমনকি বিনোদনমূলক কর্মকান্ডও বন্ধ করে দেয়। কেউ এসব কাজে জড়ালে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। তখন তারা আফগানিস্তানজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। ধ্বংসযজ্ঞ চালায় দেশটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। ধুলিসাৎ হয় মানবতা।

আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিন সেনাদের দুই দশক

টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জেরে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী আফগানিস্তানে হামলা চালায়। প্রথমে তালেবানরা মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হতে চললেও ২০০৪/৫ সাল থেকেই তালেবান নামক সংগঠনটি পুনরায় সংগঠিত হয়। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি মার্কিন সেনা ও আফগান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। এই যুদ্ধের বলি হতে হয়েছে অগণিত সাধারণ মানুষকে। দুই দশক ধরে চলা দীর্ঘ যুদ্ধের পুরোটা সময় মার্কিন সৈন্যদের তালেবান ও আলকায়েদাকে মোকাবিলা করেই থাকতে হয়েছে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন ৩১ আগস্টের মধ্যে তথা নাইন-ইলেভেন দিবসের আগেই সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। ঘোষণা অনুযায়ী, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধে ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। আফগান যুদ্ধে দেশটি তাদের হাজার হাজার সৈন্য হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটি আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আলকায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেন যদি মার্কিনিদের উদ্দেশ্য হয়, তবে দুটো লক্ষ্য ১০ বছর আগে অর্জিত হয়েছে। তাহলে এতদিন পর কেন সেনা প্রত্যাহার করল? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই আফগানিস্তানে পশ্চিমা পরাশক্তি ঘেঁষা একটি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। যা অনেকটা ঔপনিবেসিক আমলের মতো। কিন্তু সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় এবং আপাতত সে লক্ষ্য পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা না থাকায় এক রকম হতাশা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
 source - Bd-pratidin.com

Post a Comment

0 Comments