Hot Posts

6/recent/ticker-posts

তালেবানরা কি ইসলামী রাষ্ট্রের নামে অন্যকিছু করছে?



তালেবান কারা?

১৯৮৯ সাল, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) সৈন্য প্রত্যাহারের পর যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, সেই যুদ্ধেই তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় ছিল তাদের দাপট। সংগঠনটি (তালেবান) আফগানিস্তানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে সংগঠনটি একই সঙ্গে আফগানিস্তানে ইসলামী অনুশাসনও চালু করে। ১৯৯৮ সাল নাগাদ তারা আফগানিস্তানের প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারা ইসলামী শরিয়া শাসনের পাশাপাশি চালু করে নিষ্ঠুর শাস্তির প্রচলন। পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং মেয়েদের বোরকা পরতে বাধ্য করা হয়। সে সময় থেকে নিষিদ্ধ করা হয় টিভি, সংগীত এবং সিনেমা। আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর তারা পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় নতুন করে সংগঠিত হয়। তাদের প্রায় ৮৫ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আছে বলে মনে করা হয়। ২০০১ সালের পর তারা এখন সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় আছে।

ইসলামী রাষ্ট্রের নামে ধ্বংসযজ্ঞ

যুক্তরাষ্ট্র তাদের দীর্ঘতম যুদ্ধের সমাপ্তি টেনে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিয়েছে। দেশটি তাদের হাজার হাজার সেনা হারিয়েছে। এ ছাড়াও লাখ লাখ আফগান সেনা এবং বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু পর্যবেক্ষণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধে ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। তবে এতে আফগানিস্তানের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেনি। বরং পরিস্থিতি ক্রমেই আরও খারাপ হতে চলেছে। দেশটিতে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে তালেবান সশস্ত্র গোষ্ঠী। ধর্মের নামে তারা প্রাচীন স্থাপনা ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী এবং তাদের উপাসনালয় ধ্বংস করে চলেছে। আজকের সাধারণ আফগানদের জীবন ২০০১ সালের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন। ২০০১ সালে যখন দেশটিতে মার্কিন সেনা মোতায়েন শুরু হয়, তখনকার তুলনায় গত বছর নাগরিক হতাহত প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি দেখা গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতা অনেক বেড়েছে। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিতে সামরিক হামলা নিয়ে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে তালেবান। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও আফগান কর্মকর্তাদের মতে, তালেবানের ইতিহাসে শুধুই বর্বরতা। ইসলামী শাসন কায়েমের নামে মানুষ হত্যা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা, প্রাচীন স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়াসহ নানা অপরাধমূলক কাজ করে চলেছে দেশটির সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী। আফগানিস্তানের কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোকে জানিয়েছে, তালেবানরা ক্ষমতায় এলে তাদের পূর্ববর্তী শাসনামলের মতোই তারা নৃশংস ধর্মান্ধতা চাপিয়ে আফগানিস্তানকে আবার কয়েক যুগ পেছনে ঠেলে দেবে। তালেবানরা ইসলামী শাসনের নামে মহিলাদের বাড়িতে আটকে রাখবে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেবে এবং ভুল পোশাক পরিধান বা ভুল সংগীত শোনার মতো পাপের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবে। মানবতা হারাবে প্রাচীনতম দেশটি।

তালেবান এখনো কীভাবে শক্তিশালী?

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও আফগানিস্তানের কর্মকর্তাদের মতে, তালেবান যেভাবে আফগান শহর দখল করছে, তাতে ভবিষ্যৎ বিশ্ব বেশ হুমকির মুখে রয়েছে। আর তালেবান গোষ্ঠীর শক্তির উৎস সম্পর্কে গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে অজানা। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তালেবানের অর্থের উৎস অস্পষ্ট। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তালেবানের বার্ষিক আয় ৩০ কোটি থেকে ১৫০ কোটি ডলার হতে পারে। তাদের আয়ের বড় অংশ আসে মাদক ব্যবসা থেকে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এবং দখল করা এলাকা থেকে কর আদায়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তারা। আবার তালেবানের শক্তিমত্তা সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। তবে গত বছর জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের পর্যবেক্ষকরা বলেন, সশস্ত্র সংগঠনটির ৫৫ থেকে ৮৫ হাজার যোদ্ধা রয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের পর্যবেক্ষকদের মতে, এখন পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তাতে স্পষ্ট যে, জনবল, অর্থ, অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য তালেবানকে বেগ পেতে হয় না। অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তান, ইরান ও রাশিয়া তালেবানকে রসদ ও পরামর্শ দিচ্ছে। তবে দেশ তিনটি এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

যুদ্ধে ধ্বংস ঐতিহাসিক স্থাপনা

মাত্র কয়েক দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে নিজের ও ন্যাটো বাহিনী সরিয়ে নিয়েছে। এরই মধ্যে আফগানিস্তানের ২৯টি প্রদেশের ১১৬টি জেলা নিজেদের দখলে নিয়েছে তালেবান। দেশটির এক সরকারি কর্মকর্তা দাবি করেছে, ১১৬টি জেলা দখল করার সময় তালেবান ধ্বংস করেছে নানা সরকারি স্থাপনা। বাজার মূল্য হিসেবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার। তালেবানের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর ২৬০টি সরকারি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। ২০০১ সালে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আক্রমণের পরও বেপেরোয়া হয়ে উঠেছিল তালেবান বাহিনী। সে সময়ও তারা একের পর এক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল দেশটির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে। আফগানিস্তানের গৌরবোজ্জ্বল অতীত এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নীরব সাক্ষী যেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বুদ্ধের মূর্তি দুটি। ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধদের অন্যতম কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় এই বামিয়ান। কয়েক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুর বসবাস ছিল তখন এই উপত্যকায়। আফগানিস্তানের এই বৌদ্ধ মন্দিরটিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্তি¡ক নিদর্শনের স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউনেস্কো। ২০০১ সালে হামলা চালিয়ে এটি প্রায় ধ্বংস করে দেয় তালেবান বাহিনী। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ইসলামিক এবং প্রাক-ইসলামিক বহু স্থাপনা ধ্বংসের খেলায় মেতেছে তালেবান বাহিনী। প্রথম অ্যাংলো-আফগান, দ্বিতীয় সোভিয়েত-আফগান এবং তৃতীয় যুক্তরাষ্ট্র-আফগান যুদ্ধে দেশটির বহু প্রাচীন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। তালেবানদের দাবি, তারা ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের ৮৫ ভাগের বেশি এলাকা দখল করেছে। যদিও এটা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কও আছে। তবে এটা ষ্পষ্ট যে, আফগান সেনারা দেশটিতে তালেবান বাহিনীর অগ্রগতি থামাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে। এমতাবস্থায় দেশটির প্রত্নতাত্তি¡ক বিশেষজ্ঞরা বলছে, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আফগানিস্তানের প্রাচীন ঐহিত্য। তালেবান পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে এ দেশটির সব প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করে দেবে তালেবান। হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে।





বিশ্বজুড়ে আফগান শরণার্থীদের ঢল

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালে বিশ্বে গড়ে প্রতিদিন ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এতে প্রতি দুই সেকেন্ডে বাস্তুচ্যুত হয়েছে একজন। সব মিলিয়ে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ১০ লাখ, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড। জাতিসংঘ বলছে, এসব শরণার্থীদের মধ্যে আফগান নাগরিকই বেশি। ১৯৭৯ সালের সোভিয়েত ও আফগান বড় ধরনের সেই লড়াইয়ে ২৮ লাখ আফগান পাকিস্তানে এবং ১৫ লাখ আফগান ইরানে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। ১০ বছর ধরে চলা সেই যুদ্ধ শেষে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বিদায় নেয়। এরপর কেটে যায় আরও ১০ বছর। টুইন টাওয়ারে হামলার জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের উৎখাতের পর ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ দেশে ফিরে গেছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, এখনো প্রায় ২০ লাখের বেশি আফগান নাগরিক পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছে। বর্তমান সহিংসতার কারণে যাদের অনেকেই দেশে ফেরার ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহী নয়.

Source -https://www.bd-pratidin.com

Post a Comment

0 Comments